পরিবেশ-পঠন নিয়ে চারবার দেশসেরা রাজশাহী কলেজ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ল প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে গড়া একটি ভবন। এর সামনে শিক্ষার্থীদের উল্লাস। তাঁদের হাতে হাতে মিষ্টি। এখানে একটি আনন্দ র‌্যালির আয়োজন করা হচ্ছে। আনন্দ-উচ্ছ্বাস হবেই বা না কেন, পর পর চারবছর দেশসেরার খেতাব অর্জন করেছে এ কলেজ। বুধবার সকালে রাজশাহী কলেজে ঢুকতেই এ দৃশ্য চোখে পড়ল।

আগের দিন মঙ্গলবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোর ২০১৮ সালের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে। এতে ৭০.৫৪ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম রাজশাহী কলেজ। ৩১টি ক্রাইটেরিয়ার ওপর ভিত্তি করে ২০১৫ সাল থেকে র‌্যাংকিং প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রথম বছর থেকেই প্রথম স্থান ধরে রেখেছে এই কলেজ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষার পরিবেশ ও পঠনের গুরুত্বে এ অর্জন রাজশাহী কলেজের।

এই অর্জনের নেপথ্যে আছেন আরেকজন। তিনি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান। বুধবার সকালে যখন আনন্দ র‌্যালিতে যোগ দিতে তিনিও এসেছিলেন। শিক্ষার্থীদের বাড়তি আগ্রহ দেখা গেল তাঁকে ঘিরে। সবাই যেন ব্যস্ত সাবেক এই অধ্যক্ষের সঙ্গে সেলফি তুলতে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, হবিবুর রহমান অধ্যক্ষ থাকাকালে প্রথমবার দেশসেরা হয় রাজশাহী কলেজ। ২০১৮ সালের সর্বশেষ র‌্যাংকিংয়ের সময়ও তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনিই কলেজে নিয়ম-শৃঙ্খলা এনেছেন, যা ধরে রেখেছেন বর্তমান অধ্যক্ষ আবদুল খালেক।

কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আলী বলেন, এখানে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। কলেজের পরিবেশ, সুবিশাল ক্যাম্পাস, পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখানোর যে প্রেষণা সেটা হয়তো অন্য কলেজগুলোর চেয়ে ভিন্ন। এ কারণেই আমাদের কলেজ স্বতন্ত্র একটি জায়গা পেয়েছে। আর এক্ষেত্রে রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহা. হবিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দক্ষতা প্রশংসনীয়ই শুধু নয়, অনুকরণীয়। তিনিই কলেজকে পাল্টে দেওয়ার কারিগর।

কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজশাহী কলেজের শিক্ষকরা সবসময় চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের আন্তরিকভাবে পাঠদান করতে। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলো সহজেই শিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। এছাড়া কলেজ প্রশাসনও অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে। পড়াশোনার বাইরে বুদ্ধিভিত্তিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অংশ গ্রহণেও তৎপরতা প্রচুর। সর্বোপরি একজন শিক্ষার্থীকে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করা হয়। এ কারণেই জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার এই গৌরব কলেজের।

এ অর্জনে বুধবার আনন্দ র‌্যালি শুরুর আগেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উল্লাস দেখা যায়। শিক্ষার্থীর সঙ্গে আসা অনেক অভিভাবককেও দেখা গেল আনন্দে মেতে উঠতে। বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে ছিলেন সবাই। পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশও দেখা গেল। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই এখানে চোখে পড়ে প্রাচীন স্থাপত্যশৈলে গড়া একটি ভবন। এ ভবনের পেছনেই আছে ছোট্ট একটি পুকুর। এর পাড়গুলোতে বসানো হয়েছে টাইলস। আছে শানবাঁধানো কয়েকটি ঘাট। পুকুরের পানির ওপর ফুটে আছে শখানেক পদ্মফুল।
সাজানো-গোছানো ক্যাম্পাসের দক্ষিণে সুবিশাল খেলার মাঠ। এই সব পরিবেশই পয়েন্ট যোগ করেছে র‌্যাংকিংয়ের জন্য। তবে ধারাবাহিক সাফল্যের পেছনে সাবেক অধ্যক্ষ হবিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বের কথা উঠে আসছে বার বার।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, কলেজকে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছেন সাবেক অধ্যক্ষ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সর্ম্পককে সুদৃঢ় করেছেন। পুরো ক্যাস্পাসকে শিক্ষার্থীবান্ধব করে সাজিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের প্রয়োজনগুলো বোঝার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষার্থীদের মনোজগতের ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলাবোধ শিখিয়েছেন। ক্লাস রুমের ভেতর থেকে বাইরে সবকিছুর সার্বক্ষণিক তদারকি করেছেন। শিক্ষকদের আন্তরিকভাবে পাঠদানে উৎসাহিত করেছেন। আর এসব কারণেই রাজশাহী কলেজ শ্রেষ্ঠ হচ্ছে।

এসব নিয়ে কথা হয় সাবেক অধ্যক্ষ হবিবুর রহমানের সঙ্গেও। তিনি বলেন, রাজশাহী কলেজ শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়েই নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের র‌্যাংকিংয়েও পরপর চারবার দেশসেরা। তাঁর মতে, যে কোনও কাজের প্রতি ভালোবাসা, একাগ্রতা, সততা ও স্বচ্ছতা থাকতে হয়। তিনি সেটা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, রাজশাহী কলেজের সার্বিক উন্নতির জাদু সর্ম্পকে অনেকেই জানতে চান। এক কথায় বলতে গেলে, আমরা শিক্ষার্থীদেরকে ইতিবাচকভাবে বদলে যেতে দেখেছি। আমরা শিক্ষার্থীদের সুযোগ করে দিয়েছি, প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছি। যা অনেক প্রতিষ্ঠানই করে উঠতে পারেনি।

বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহা. আব্দুল খালেক বললেন, রাজশাহী কলেজ সব সময় শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। আজকের এই সাফল্যের পেছনে সাবেক অধ্যক্ষ হবিবুর রহমানের বড় ভূমিকা রয়েছে। তাঁর এনে দেওয়া সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাফল্যের মাত্রাকে আরও উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে কাজ চলছে। আগামীতে রাজশাহী কলেজ আরও সুনাম করবে বলেই তাঁর বিশ্বাস।

রাজশাহী নগরীর প্রাণকেন্দ্রে এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৩ সালে। এরপর ১৮৭৮ সালেই প্রথম গ্রেড মর্যাদা পায় কলেজটি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর এখানে চালু হয় বিএ কোর্স। এরপর ১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে শুরু হয় হয় বিএল কোর্স। এখন মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রির পাশাপাশি চালু রয়েছে উচ্চমাধ্যমিককের পড়াশোনাও। মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ কলেজে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি।

জি/আর