পরিচ্ছন্ন ঢাকা গিনেস বুকে নাম নয়, সত্যিকার কাজ করুন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য প্রতীকী পরিচ্ছন্নতার কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) হাজার হাজার নাগরিককে নিয়ে শুক্রবার শহর পরিষ্কার রাখার কাজ করেছে। বেলা ১১টায় শুরু হওয়া এই কর্মসূচি চলে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। অর্থাৎ আধা ঘণ্টায় তাঁরা রাজধানী শহরের দক্ষিণাংশ পরিচ্ছন্ন করার কাজ শেষ করেছেন। ডিএসসিসির দাবি, প্রতীকী এই পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন। তবে নিবন্ধন করেছিলেন ১৫ হাজার ৩১৩ জন।

আমরা যদি ধরে নিই, ৩০ হাজার নয়, ১৫ হাজার মানুষ এই পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন, সেটিও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর আগে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে গিনেস বুকে নাম লেখাবে। হয়তো ইতিমধ্যে লিখিয়েও ফেলেছে। এর আগে গত বছর ভারতে এ রকম একটি প্রতীকী পরিচ্ছন্নতার কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন ৫ হাজার ৫৮ জন মানুষ। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সংখ্যাটি তিন গুণ।

কিন্তু যে শহরে (উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মিলে) দেড় কোটি মানুষের বাস এবং অধিকাংশ সড়ক ও ফুটপাত নোংরা আবর্জনায় ভরা, সেই শহরে লোকদেখানো প্রতীকী পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচির আদৌ কোনো তাৎপর্য আছে কি না, সেটি ভেবে দেখার বিষয়। প্রথম আলোর অনলাইনের খবরে বলা হয়, ‘এই কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। বেলা ১১টার পর সব অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে গোলাপশাহ মাজার, জিরো পয়েন্ট, পল্টন মোড় এলাকায় পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়। সাড়ে ১১টার দিকে এই কর্মসূচি শেষ হয়। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে পল্টন মোড়ে অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানান ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন।’

মেয়র সাঈদ খোকন যদিও বলছেন, ‘আজকের এই কর্মসূচিটিতে রেকর্ড গড়া আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না; কিন্তু মনে হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য ছিল সেটাই। তিনি মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রায় তিন বছর হলো। এই তিন বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দৃশ্যমান একটি উন্নয়নকাজ করেছে, মনে পড়ে না। তিনি বলেছিলেন মশার উপদ্রব থেকে ঢাকাবাসীকে মুক্তি দেবেন। পারেননি। বলেছিলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত রাখবেন। পারেননি। বলেছিলেন, সবার সঙ্গে পরামর্শ করে সিটি করপোরেশন চালাবেন; সেটা কতটা করতে পেরেছেন, দক্ষিণের বাসিন্দারা বলতে পারবেন। তবে আমরা সাদাচোখে দেখছি নগরবাসীর দুর্ভোগ আগের চেয়ে কমেনি; বরং বেড়েছে।

উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র অন্তত দুই-তিনটি ভালো কাজ করে দেখিয়েছেন। তেজগাঁওয়ে সাত রাস্তার মোড়ে সড়ক দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড বসানো হয়েছিল। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সড়ক দখল করে নিয়েছিলেন পরিবহনের মালিকেরা। আনিসুল হক দুটোই পরিষ্কার করে যাত্রীসাধারণের চলাচলের জন্য সড়ক খুলে দিয়েছেন। তাঁর আরও কিছু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। অকালে মারা না গেলে হয়তো সেগুলোও করতে পারতেন।

যেখানে ঢাকা শহরের যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মশার উপদ্রবে জনজীবন বিপন্ন, সেখানে দক্ষিণের মেয়রের কেন প্রতীকী পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে গিনেস বুকে নাম লেখানোর ইচ্ছে হলো, আমরা বুঝতে অপারগ। তবে আমাদের নেতা-নেত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের সব ক্ষেত্রে রেকর্ড গড়ার বদ-অভ্যাসে পেয়ে বসেছে। নির্বাচনের আগে জনপ্রতিনিধিরা গ্রিন ঢাকা, ক্লিন ঢাকা, নতুন সিঙ্গাপুর-হংকং-ব্যাংককের গল্প শোনালেও নির্বাচনের পর সব বেমালুম ভুলে যান। নগর ভবনের জৌলুস যত বাড়ছে, নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা তত কমছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) হাজার হাজার নাগরিককে নিয়ে শুক্রবার শহর পরিষ্কার রাখার কাজ করেছে। প্রতীকী পরিচ্ছন্নতার কর্মসূচি হিসেবে এটি করা হয়। ছবি: প্রথম আলোসাঈদ খোকন ঢাকা শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে চাইলে প্রথমেই উচিত ছিল তাঁর বাবা সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নামে প্রতিষ্ঠিত উড়ালসড়কের নিচের জঞ্জালগুলো পরিষ্কার করে মানুষকে নিত্যদিনের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করা। মোহাম্মদ হানিফ উড়াল সড়কটি চালু হওয়ার পর থেকেই নিচে ময়লা আবর্জনার স্তূপ জমে আছে। অভিযোগ, নিচ দিয়ে যাতে কোনো যানবাহন চলাচল করতে না পারে, সে জন্য উড়ালসড়ক কর্তৃপক্ষই এ অবস্থা করে রেখেছে। আর মেয়র সেটি দেখেও না দেখার ভান করছেন।

তিনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, শহর পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটি আধা ঘণ্টা বা এক দিনের বিষয় নয়। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত শহরটি পরিচ্ছন্ন ও জঞ্জালমুক্ত রাখতে হয়। একসময় কলকাতাকে বলা হতো উপমহাদেশের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন নগরী। ঢাকা সেই সেই কলকাতাকেও অনেক আগে পেছনে ফেলে অপরিচ্ছন্ন নগরীর রেকর্ড গড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, ঢাকা হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় বসবাস-অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। আফ্রিকার কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরী হয়তো ১ নম্বরে আছে।

মেয়র বলেছেন, পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্যই তিনি এ উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরাও স্বীকার করি, জনসচেতনতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার আগে তো নগরবাসীর করে যাঁদের বেতন হয় অর্থাৎ সিটি করপোরেশনের কর্মীদের সচেতন হতে হবে। সিটি করপোরেশনে কর্মীরা কি ঠিকমতো কাজ করছেন? না করলে মেয়র তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? ঢাকা শহরে প্রায়ই দেখা যায় বেলা ১০/১১টার সময় পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সড়ক ঝাড়ু দিচ্ছেন আর পথচারী ও যানবাহনের যাত্রীদের গায়ে ময়লা আবর্জনা এসে লাগছে। দুর্গন্ধে পথচারীরা হাঁটতে পারছে না। সড়কে ঝাড়ু দেওয়ার কথা রাতে বা খুব ভোরে, যখন সেগুলো ফাঁকা থাকে।

ঢাকায় রাস্তার ওপর যে নির্মাণসামগ্রী রড, ইট, বালু, খোয়া, সিমেন্ট ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, সেগুলো বন্ধ করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কি মেয়র নিতে পেরেছেন? বছরখানেক আগে ঘটা করে তিনি সড়কের দুই পাশে ময়লা ফেলার ঝুড়ি বসিয়ে ছিলেন, কয়েক দিন না যেতেই সেগুলো উধাও। এই যে বিপুল অর্থের অপচয় হলো, সেই হিসাব কে দেবে?

এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার টন ময়লা-আবর্জনা জমে। এর মধ্যে ডিসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সর্বোচ্চ তিন হাজার টন পর্যন্ত অপসারণ করেন। বাকি চার হাজার টন ময়লা-আবর্জনার যন্ত্রণা পোহাতে হয় নগরবাসীকেই।

মেয়র পরিচ্ছন্ন নগরী গড়তে নগরবাসীর মন-মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটানোর কথা বলেছেন। কিন্তু সবার আগে সিটি করপোরেশন তথা মেয়রের মন-মানসিকতার যে পরিবর্তন প্রয়োজন, সে কথাটি তিনি কীভাবে অস্বীকার করবেন? এসব লোকদেখানো কর্মসূচি দিয়ে আর যা-ই হোক, পরিচ্ছন্ন নগরী গড়া যাবে না।

 

প্রথম আলো