পরিক্রমায় মানুষ: প্রসংগ বাংলাদেশ

যখন নবম বা দশম শ্রেনীতে পড়ি তখন এক জৈষ্ঠ ভদ্রলোক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য কি? আমি উত্তরে বলেছিলাম মানুষের বুদ্ধি আছে, অনুভূতি আছে কিন্তু অন্যান্য প্রানীর তা নেই। ভদ্রলোক তখন হেসে বলেছিলেন, অন্যান্য প্রানীরও তো বুদ্ধি -অনুভূতি আছে , যেমন গরু নিজের বাচ্চাকে ঠিকই চিনে নিয়ে আদর করে – দুধ খেতে দেই । তখন বুঝলাম আমার উত্তর ঠিক হয়নি। ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম সঠিক উত্তর জানার অপেক্ষায়। উনি তখন বুঝিয়ে বললেন যে , মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য হলো মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম সেই ব্যাপারে আরও উৎকর্ষ লাভ করে উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। আর অন্যান্য প্রানী পূর্বসূরীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে না, ফলে একই কাজ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম করে যায়। তখন আমার মনে হলো একজন যথার্থ মানুষ মাত্রই অতীত অভিজ্ঞতা বা ইতিহাস থেকে অবশ্যয় শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্ম কে আরোও সমৃদ্ধ করবে ; এটাই মানুষ পরিচয়ে পরিচিত হবার অন্যতম প্রধান মাপকাঠি।

আমরা মানুষ । আমরা এশিয়া মহাদেশের দক্ষিন অঞ্চলের মানুষ । আমরা ভারতীয়, বিভিন্ন ধর্মের – সম্প্রদায়ের মানুষ । জাতিগত ভাবে বাজ্ঞালি মানুষ। উপরের শর্তের আলোকে আমরা কত টুকু মানুষ হতে পেরেছি সেটা পর্যালোচনার বিষয়। আমার এত বেশি জ্ঞান নেই যে এটা নিয়ে পরিপূর্ণ  আলোচনা করে কোন সিদ্ধান্ত দাড় করাবো। আমি শুধু রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করার ফলে আমাদের জীবনে কি দুর্বিষহ বিপর্যয় নেমে এসেছে বার বার এবং এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রকৃত মানুষ হওয়ার অথ্যাৎ অভিজ্ঞতা থেকে শিখার যে শর্ত মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রযোজ্য সে বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের সামর্থ্য অনুযায়ী সামান্য আলোচনার চেষ্টা করবো ।

আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেক জ্ঞানী ছিলেন, সভ্যতার মানদন্ডে অবশ্যয় অন্যান্য মহাদেশের মানুষের তুলনাই অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিলেন একথা বলতে কোন দ্বিধা নেই । কেননা তা না হলে সিন্ধু সভ্যতা তারা সৃষ্টি  করতে পারতেন না , প্রাচীন নানা সমৃদ্ধ গ্রন্থসমুহ রচনা করতে পারতেন না , মানবিক মুল্যবোধ সৃষ্টিতে মানব প্রেমের ধর্মের বানী প্রচার করতে পারতেন না । প্রাচীন যুগ থেকে বিষেশত বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক শশাষ্কের পর থেকে পাল শাসনের সময়ও নিজ রাজ্যে অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ যথেষ্ট প্রধান রূপে গুরুত্ত পেত । সাম্প্রদায়িক বিষ্পাপ থকে মুক্ত ছিলেন তারা । পাল রাজারা বৌদ্ধ হলেও তাদের প্রশাসনিক গুরুত্তপূর্ণ পদ সমুহে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও যোগ্যতা অনুযায়ী দায়িত্ত্ব পালন করতেন। সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই যথাযথ মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল । সেন আমল ও পরবর্তী মুসলিম আমলেও  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি মোটামুটি ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল তা ইতিহাসে প্রমাণিত।

যত বিপত্তি ঘটল ইংরেজ শাসনের সময় থেকে ; ধর্ম হয়ে উঠল রাজনীতির হাতিয়ার । আমরা ভাগ হতে থাকলাম  ধর্মে –বর্ণে – গোত্রে নানা শাখা প্রশাখায়। সৃষ্টি হলো ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ; জাতিসত্ত্বা ভূলে ধর্মের ভিত্তিতে নিজেরা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। কংগ্রেস তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বিসর্জন দিয়ে আচরণে হিন্দু সাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়ে গেল। আর মুসলমানরা সৃষ্টি করল মুসলিমলীগ নামক আরেক সাম্প্রদায়িক দল। দুই সম্প্রদায়ের দুই প্রধান দলের  অবিশ্বাষ আর প্রতিযোগিতা্র নানা পরিক্রমায় ভারত বিভক্তির চিত্র ফুটে উঠতে থাকে । ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তারিখে মোহাম্মাদ আলী জিন্নার রুপরেখায় ঘোষিত হলো দ্বীজাতি তত্ত্বের লাহোর প্রস্তাব । যার ধারাবাহিকতায় এই ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট তারিখে বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটেছিল ভারতবর্ষকে দ্বিখন্ডিত করে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং অপরটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ দাবি করেছিলেন ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি, তারা এক দেশে এক সাথে থাকতে পারে না । তার এই দাবি বৃটিশ শাসকরা স্বাদরে গ্রহন করেছিল কেননা তাদের উপনিবেশিক শাসনের মূল নীতিই ছিল ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ । ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত করে স্বতন্ত্র মুসলিম ও হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল্য দিতে গিয়ে শত শত মানুষ জীবন হারিয়েছে , লক্ষ লক্ষ প্রতিষ্ঠিত পরিবার বাড়ি-ঘর হারিয়ে দেশছাড়া হয়ে সর্বশান্ত হয়েছে, কোটি কোটি মানুষের জ়ীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্যোগ-দুর্ভোগ। বাংগালিরাও লক্ষ মুসলমানের মত জাতিসত্ত্বা ভুলে অস্তিত্ত্বকে বিলিয়ে দিয়ে ধোয়াচ্ছন্ন অবাস্তব স্বপ্নের বিভোরে মিথ্যা স্বাধীনতার আশায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছিল। যদিও এই স্বপ্নের ঘোর কাটতে তাদের খুব বেশি সময় লাগেনি।

৩ ডিসেম্বর ২০০৫ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি আয়োজিত  ‘মুক্তিযুদ্ধের অহংকার ও বিপর্যস্ত চেতনা’ শীর্ষক আলোচনা সভার সূচনা বক্তব্যে লেখক সাংবাদিক চলচিত্রকার শ্রদ্ধেয় শাহরিয়ার কবির উল্লেখ করেছেন, “জিন্নাহর ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্ব কতটা অর্থহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় পাকিস্তানের আইনসভার প্রথম সভাপতি হিসাবে প্রদত্ত  ১১ আগস্ট ১৯৪৭ তারিখে তার ভাষণে।‘ এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা যে কোন ধর্ম , বর্ণ, ও বিশ্বাসের হতে পারেন , এর সাথে রাষ্টের কোন সম্পর্ক নেই। … আপনারা দেখবেন , সময়ের ব্যবধানে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না , মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না – ধর্মীয় অর্থে নয় , কারন এটা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অন্তর্গত , এটা হবে রাজনৈতিক অর্থে , রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে’ ।“  জিন্নাহর এই বক্তব্য থেকে স্পষ্টই বুঝাযায় তার দ্বিজাতি তত্ত্ব কোটি কোটি ভারতীয়দের সাথে প্রতারণা-প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু ছিল না । বাংগালিরা পূর্বপুরুষের শিখানো অসাম্প্রদায়িক মানবিক সম্প্রীতি থেকে বেরিয়ে নিজেরা নিজেদের থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে মারাত্রক ভুলে কলুষিত হয়েছে। চির দিনের অসাম্প্রদায়িক মানবিক বন্ধন ভাংগার ভুল ধরা পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি বাংগালিদের । পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে মোহভংগ ঘটে ভাষার প্রশ্নে । পাকিস্তানের আইনসভায় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিরোধীদলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান । তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সহ আইনসভার সকল সদস্য তার এই বক্তব্যে ধর্মীয় ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুজে পান । ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চে জিন্নাহ ঢাকায় এক জনসভায় ঘোষনা করেন, “পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। যারা এর বিরোধীতা করবে তারা পাকিস্তান তথা ইসলামের শত্রু বলে গন্য হবে ।“  অথচ এই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাংগালিদের  অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল  সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেয়। কখনো কি কোন মুসলমান বাংগালি ভেবেছিল ধর্মের নামে এই পাকিস্তানে স্বাধের স্বাধীনতায় তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন অবরুদ্ধ জলাশয়ে দূর্ভাগ্যজনক ভাবে আটকা পড়বে, সদ্য স্বাধীনতায় জন্ম নেওয়া শিশুরা বড় হয়ে নিজ সেনাবাহীনির গুলিতে অকাতরে প্রাণ দিবে । যেন বাংগালীদের জন্ম হয়েছিল রক্ত দেওয়ার জন্য, যেন তারা রক্ত দেবতার উপাসক । তাদের জন্ম হয়েছিল অস্বাভাবিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য, যেন তারা মৃত্যু দেবতার উপাসক। তাদের দেবতা ছিল ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারী, লুটেরাজ । তাদের সেই দেবতা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর সৃষ্টি ভ্রান্ত পাকিস্তানের ৪৪% পশ্চিম অংশের জনগোষ্ঠী । তারা ১৯৪৭ থেকে তৈরি হচ্ছিল মৃত্যুর জন্য, সম্ভ্রমহানীর জন্য, রক্তস্রোতে নাও ভাসিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য; সেই একাত্তরের জন্য, মহান একাত্তরের জন্য , ভয়াবহ একাত্তরের জন্য।

সেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এ জনপদের অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে  ধরাষয়ী হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে । ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত পূর্ববাংলায় সংঘটিত সকল অন্যায়-অত্যাচার ধর্মের নামে বৈধ করার প্রয়াস চালিয়েছে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি এবং তাদের সহযোগিতাকারী এদেশীও ধর্ম ব্যাবসায়ী দালালেরা; যে অপচেষ্টা এখনো বিদ্যমান । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল শান্তি বাহিনী, রাজাকার বাহিনী,  আলবদর বাহিনী, আলশামস বাহিনীসহ নামে বেনামে বিভিন্ন সংগঠন । এদের দ্বারাই প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় যার প্রমান নিজেরাই স্বগর্বে প্রকাশ করেছে। যেমনঃ ১১ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে দৈনিক সংগ্রাম প্রত্রিকায় ‘ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন’ শিরোনামে হেড লাইন করে সংবাদ ছাপা হয়। বিস্তারিত সংবাদে বলা হয়ঃ “ঢাকার দৈনন্দিন জীবন যাত্রার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে গতকাল শনিবার ১৪০ সদস্যের একটি নাগরিক শান্তি কমিটি করা হয়েছে । পূর্ব পাকিস্তানের কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খয়ের উদ্দিনকে কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে । কমিটিতে আরো রয়েছেন জনাব এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আজম, মৌলানা ফরিদ আহমদ, জনাব মাহমুদ আলী প্রমূখ।“ ১৪ নভেম্বর তারিখে আল বদর বাহিনী সস্পর্কে সংবাদ  ছাপা হয়; “ ইসলামী ছাত্র সংঘের  (বর্তমান রূপ ইসলামী ছাত্র শিবির) সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী  বলেছে পাক সেনাদের সহযোগিতায় ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের নিয়ে আল বদর বাহিনী গঠিত হয়েছে ।“ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এমন কোন দুষ্কর্ম নেয় যা এরা করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংগালিদের এত ক্ষতি কখনই হত না যদি এসব যুদ্ধাপরাধী রাজাকারেরা পাকিস্তানিদের সর্বাত্রক সহযোগিতা না করত।

লেখক, সাংবাদিক , চলচিত্রকার শ্রদ্ধেয় শাহরিয়ার করিব ‘সভ্যতার মানচিত্রে যুদ্ধ যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, “১৯৭১ সালে বংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষ নিহত হয়েছে। সরকারি হিসাবে ২ লক্ষ, বেসরকারি হিসেবে সোয়া চার লক্ষ নারী পাষবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এক কোটিরও বেশি মানুষ সর্বস্বব হারিয়ে প্রাণ বাচাবার জন্য প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল । এর দিগুনেরও বেশি মানুষ স্বদেশে উদবাস্তুর অনিশ্চিত বিড়ম্বিত জীবন যাপন করেছে। অন্ততপক্ষে ২০ লক্ষ মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ভোগ করেছে। শত সহস্র জনপদ ধ্বংস হয়েছে, সম্পদ লুন্ঠিত হয়েছে । হত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসের স্থান কাল বিচারে ’৭১-এর নয় মাসে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে সংঘঠিত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধপরাধ স্মরণকালের ইতহাসে তুলনাহীন।“ একাত্তর হারিয়েছিল  সকল মানবতা, সকল নির্মমতা , সকল বিবেক । মানবতার শত্রু সেই কালো  শক্তি যাদের সার্বিক সহযোগিতা ও সমর্থনে এত বেশি অপরাধ সংঘটিত হল তাদের বিচার হবে না !! শহীদের রক্তে বিধৌত বাংলা মায়ের প্রতি বিন্দু পবিত্র মাটিতে পদ্ঘাত করে  তারা আবার মাথা উচু করে হাটবে !! শহীদের রক্ত মাখা পতাকা গাড়ীতে উড়াবে !! আবার ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিষ্পাপ ছড়াবে মানুষে মানুষে !! তারাই কি ধর্মের বানী শুনাবে আমার যুদ্ধাহত পিতাকে – ধর্ষিত মাকে !! এদের মানবিকতাবোধ , অপরাধবোধ কোন কালেই ছিলনা, এরা ছিল রক্ত পিপাসু উম্মাদ জল্লাদ । এদেশের মানুষ তারা অথচ কতটা আনুগত্যহীন, বিশ্বাসঘাতক !  এই যুদ্ধাপরাধীরা তো মানুষ হত্যা করতো আ্নান্দ চিত্তে, ধর্ষিতের যন্ত্রনাকাতর আত্তচিতকার তাদের কাছে ছিল হামদ-নাতের মত, নিষ্পাপ শিশুর রক্তপান করেছে শূরা হিসাবে, শহীদের রক্তে তারা গোসল করেছে প্রতিনিয়ত, মেতে থেকেছে অগ্নি-সংযোগ লুটপাতে, ধ্বংস করেছে গ্রামের পর গ্রাম; এসবই তারা করেছে ধর্মের নামে, তাদের সকল অপরাধ তারা চাপাতে চেয়েছে ধর্মের উপরে্। প্রকৃত পক্ষে তারা ধর্ম কে হত্যা করে চলেছে প্রতিনিয়ত সর্বোতভাবে।

স্বাধীনতার পরে দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের আলোকে জাতির পিতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান । ধর্ম ব্যবসায়ী যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচারের ব্যাবস্থা করেছিলেন। । কিন্তু সব শেষ হয়ে যায় ১৯৭৫ সালে । ফিরে আসে আগের সেই কালো সময় । ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরাজিত ঘাতকেরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। জেলখানাতে নির্বিচারে হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতাকে । পরাজিত শত্রুদের দোসরদের কালো ছায়া আবার নেমে আসলো লাল সবুজের মানচিত্রে। রক্তে পাওয়া সংবিধানের মুলনীতিসমূহ ছুড়ে ফেলা হয় ডাসবিনে । মহান স্বাধীনতা থেকে গেলো আক্ষরিক ভাবে অমীমাংসিত। বাংলাদেশ দখল হলো পাকিস্তানী শত্রু দ্বারা। এদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেল তারা । বাঙালিত্বকে নিশ্চিত করে পুনরায় তারা পাকসারজমিন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হল। মানবতার শত্রু সেই কালো শক্তি জামাতে ইসলামী ও তার বিভিন্ন শাখা ভিন্ন ভিন্ন নামে এখনও ধর্মের নামে সর্বশক্তি নিয়ে সক্রিয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। এ প্রসঙ্গএ উল্লেখ্য একুশে পদক প্রাপ্ত বিশিষ্ট্  সাংবাদিক দৈনিক জনকন্ঠের নির্বাহী সম্পাদক শ্রদ্ধেয়  স্বদেশ রায় ০৬ মার্চ, ২০১৮ তারিখে বাংলা ট্টিবিউন অনলাইন প্রত্রিকায় ‘জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা তরুণ সমাজের দায়িত্বশিরোনামের লেখায় উল্লেখ করেছেন, “বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে যেসব সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে বাংলাদেশে একসময়ে জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন নামে ১২১টি মতো জঙ্গি সংগঠন তৈরি করেছিলো। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের সহায়তায় এখানে পাকিস্তানের জঈশে মোহাম্মদ, আলকায়েদা প্রভৃতি জঙ্গি সংগঠনের শাখা খোলা হয়েছিলো।এই সংখ্যাটি বেশি বেড়েছিলো যে সময়ে, জামায়াত-বিএনপি ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি ক্ষমতায় ছিল তখন।“
এদের কি বিচার হবে না !!  বিচার তাদের হতেই হবে ; বিচার হবে তাদের নারকীয় অপরাধের – তাদের বিকৃত আদর্শের , তদের অনুসারীদের। দেশের  জন্য সব থেকে জরুরী হল যুদ্ধের সময় সংঘটিত নৃশংশতম জঘন্য অপরাধের অভিশাপ থেকে  দেশ কে মুক্ত করা । এদের বিচার ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতাই আসার পর শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে যা এখনো চলমান । ব্যাক্তির বিচারের থেকে তাদের মতবাদের ও সংগঠনের বিচারের বিষয়ে জোর দেওয়া অনেক বেশি গুরুত্তপূর্ণ একথা সবাই জানে। দেশ বিরোধী সকল কর্মকান্ডের হর্তা কর্তা যে একাত্তরে পরাজিত স্বাধীনটা বিরোধীরা এটি বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে বহুবার প্রমানিত হয়েছে। তার পরও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে এবং আইনের নানা মারপেচে আজও দল হিসাবে জামাত কে নিষিদ্ধ করা সহ ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এ সকল কারনে স্বাধীনতা চেতনা  বিপন্ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত । স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই রকম হাজারো ঘটনার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা আবার জীবন দিচ্ছি । অকাতরে মারা পরছে রাস্তা-ঘাটে , বাসভবনে , কর্মস্থলে।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, মানুষ তো প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে পূর্বপর্তী প্রজন্মের রেখে যাওয়া অভিজ্ঞতা দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে। আমরা কি তাহলে মানুষ হবো না রাজনীতিতে ধর্মের ভয়াবহ ব্যবহার থেকে শিক্ষা নিয়ে ; এই চর্চা নিষিদ্ধ করে পরপর্তী প্রজন্মের জন্য অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন মানবিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করে দিয়ে। শ্রদ্ধেয় স্বদেশ রায়ের পূর্বক্তো লেখার কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, “এখন তরুণ যে- আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে নেমে পড়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার। কেউ যেন কারও জন্যে অপেক্ষা না করে। পথে নামলেই পথ চলা হয়। আর পথে এগুলেই সংখ্যা বাড়তে থাকে, সারি দীর্ঘ হয়। দীর্ঘ সারি একসময় পথের শেষে বিজয়ের মালা নিয়ে আসে। সে বিজয়ের মালা হলো আধুনিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করা। যেখানে যে যার মতো মুক্তমনে চিন্তা করবে। কেউ কারও চিন্তাকে চাপাতি দিয়ে বাধা দেবে না।“

এভাবেই আমরা পরিপূর্ণ মানুষ হব পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন মানবিক বাংলাদেশ রেখে যাব। যেখানে  ধর্মের নামে – ধর্ম বেচে মানুষ হত্যা হবে না , মানুষ কিনে ধর্ম হত্যা হবে না।

 

মতিউর রহমান (মর্তুজা)

সাবেক সভাপতি , একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।