পদ্মা সেতুর সমালোচকদের গতানুগতিক বচন ও রাজনীতির পচন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক

গত ১৪ জুন রাতে পদ্মা সেতুতে একত্রে সব আলো জ্বলে উঠল। সারা দেশের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত। সেই রাত থেকে আলোকময় সেতুর ছবিগুলো দেখছি, গভীর মনোযোগ সহকারে। অপূর্ব। সেতুর উপরে আলো। নিচেও আলো। সেতুর আলোকছটা পানিতে পড়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা বেয়ে সারা দেশে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যেন আবেগ উপচে পড়ছে। আমারও। আমিও যে দক্ষিণের।

মনে পড়ে প্রথমবার যশোর থেকে ঢাকায় আসার কথা। পথে দু’টি ফেরি। কামারখালী আর আরিচা। ঢাকা যাওয়ার রাস্তা যেন আর শেষ হয় না। বিকেলে রওনা দিয়েছি যশোর থেকে। আরিচাতে দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সকালে পৌঁছেছি ঢাকার ফুলবাড়িয়ায়। শেষ ওই পথ পাড়ি দিয়েছি এক যুগ আগে। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ ঠেঁকেছে পনেরো ঘণ্টায়। অনিশ্চিত যাত্রা। কখন গন্তব্যে পৌঁছবে তা কেউ বলতে পারে না। তাই পদ্মা সেতুতে যখন আলো জ্বলল, সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে আমার মনেও জ্বলে উঠলো আলো। কারণ আমি জানি এ আলো আমাকে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। নিশ্চিত যাত্রা, নিশ্চিত গন্তব্য।

দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মনে যখন নিশ্চিত গন্তব্যের আলো জ্বলে উঠল, তখন কারও কারও মনে আলো নয়, আগুন জ্বলে উঠছে। সে আগুনে কেউ কেউ পদ্মার বুকে দেখছে সার্কাস। আবার কেউ দেখছে সেতুর প্রস্তর খণ্ডে নিজ নেতানেত্রীর নাম। আবার কেউবা মনের ক্ষোভে বলেই ফেলছেন- ‘পদ্মা সেতু নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কী আছে? পদ্মার ওপর সেতু তো আগেও হয়েছে। লালন সেতু হয়েছে। তখনতো এত বাড়াবাড়ি হয়নি।’ ভাবখানা এমন যে, তাদের আমলে এ সেতু হলে তারা কিছুই করত না। একদিন সকালে দেশবাসী ঘুম থেকে উঠে শুনত আজ থেকে সেতু খুলে দেওয়া হয়েছে। তোমরা নিশ্চিন্তে সেতুর ওপর দিয়ে যাও। যেসব নেতা এসব সার্কাস দেখছেন বা স্বপ্ন দেখছেন তারা কেউই দক্ষিণবঙ্গের নয়, সবাই উত্তরবঙ্গের। যারা বছরের পর বছর ধরে আরিচা মাওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকেছেন তাদের আবেগ বোঝার ক্ষমতা এসব নেতাদের নেই। কোথায় লালন সেতু আর কোথায় পদ্মা সেতু। লালন সেতুর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। পদ্মার দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ২০০৪ সালে নির্মিত লালন সেতুর ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকার বাজেটে ২৩ শতাংশ সরকার জোগান দেয়। বাকি টাকা দেয় জাপান।

পদ্মা সেতুর পুরাটাই আমাদের টাকায়। তাই এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশবাসীর আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা। বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিশ্ব মোড়লদের অভিযোগ, অনুযোগ, চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক। এটি কেবল একটি স্থাপত্য শিল্প নয়, এটি বাংলাদেশের মেরুদণ্ড। বাংলাদেশকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখার স্থাপত্য। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জবাব দেওয়ার শিল্পকর্ম। অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার স্তম্ভ। যেসব নেতা দেশবাসীর এসব অনুভূতি অনুধাবণ করতে পারছেন না ভবিষ্যতে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে আমি সন্দিহান। খেয়াল করে দেখুন, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের যে ২১টি জেলা এ সেতু থেকে উপকৃত হবে, সেসব অঞ্চলের সরকারবিরোধী নেতারা এসব কথা বলছেন না। সরকারের সাফল্য সহ্য করতে পারছেন না। কিন্তু পদ্মা সেতুতে সার্কাস দেখছেন না। অযথা স্বপ্ন দেখছেন না। চুপ করে আছেন। কারণ তারা জানেন, এলাকার মানুষের আবেগ অনুভূতিতে আঘাত করলে তার ভোট কমে যাবে।

চার জুন রাতে ঘটল সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি। পরদিন সন্ধ্যায় ফেসবুকে আমি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। ‘২৫ জুন পর্যন্ত হরতাল বা নাশকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না!’ দেশের সমসাময়িক রাজনীতির ধারা হিসাব করলে এমন সম্ভাবনা আসলেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তারপর কী হলো? ৫ জুন পাবনার বেড়ার কিউলিন ইন্ডাস্ট্রি। ৬ জুন রাজধানীর বসিলার জুতার কারখানা। ১০ জুন রাজধানীর নর্দ্দা এলাকায় তুরাগ পরিবহন। ১১ জুন মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটের ফেরি। একই দিনে মৌলভীবাজারে পারাবত এক্সপ্রেসের তিনটি বগি। ১২ জুন রাজশাহী স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা খুলনাগামী সাগরদাঁড়ি আন্তঃনগর ট্রেন। একই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক চিকিৎসকের রুম। ২০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক। সবখানেই আগুন। সব কি দুর্ঘটনাবশত লেগে যাওয়া আগুন? কই! স্বাভাবিক সময়ে তো এত আগুন লাগে না! নাকি এটি প্রতিহিংসার আগুন! ব্যর্থতার আগুন! বুকে জ্বলার আগুন! হিসাবের আগুন! খোদ সরকারপ্রধান এসব আগুনের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য আছে। যারা পদ্মা সেতুর বিরোধিতাকারী তারা এমন কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাবে যাতে আমরা ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করতে না পারি’। তিনি সব নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়েছেন। কড়া নজরদারির নির্দেশনা দিয়েছেন।

লেখক : প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট।

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন