নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রে কী হবে?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

এবারের মার্কিন নির্বাচন দুটি কারণে বিশিষ্ট। প্রথম কারণটি হচ্ছে, এর প্রচারণায় ভব্যতা-সভ্যতার অভাব দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, দুই প্রার্থীর মধ্যকার পার্থক্য: একদিকে ক্ষমতাকাঠামোর বিরোধী ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প, অন্যদিকে আছেন মার্জিত হিলারি ক্লিনটন। এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় মার্কিন সমাজের এক গভীর ত্রুটি বেরিয়ে এসেছে। এতে দেশটির বৈশ্বিক সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। মার্কিনরা এ ব্যাপারে একমত, প্রচারণা-পর্ব অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। মার্কিন নাগরিকেরা সাধারণত কোনো বিষয়ে একমত হন না, তার মধ্যে এই একটি বিষয়ে তাঁরা একমত হয়েছেন। কিন্তু শিগগিরই এটা শেষ হয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এরপর কী হবে?

 
জরিপে দেখা যাচ্ছে, সাবেক সিনেটর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বিতর্কিত প্রার্থী ট্রাম্পকে পরাজিত করবেন। কিন্তু জরিপকে বাস্তবতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ, জুনে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট গণভোটের আগেও মানুষ ধারণা করেছিল, ব্রিটেন ‘থেকে যাওয়ার’ পক্ষেই ভোট দেবে। আরও সম্প্রতি কলম্বিয়ার ভোটাররা দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের এক শান্তিচুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। অথচ ধারণা ছিল, এই শান্তিচুক্তি জনপ্রিয়তা পাবে।

 
এত কিছু বলার লক্ষ্য হলো, হিলারি ক্লিনটনের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ব্যাপারটা নিশ্চিত নয়। শুধু ৮ নভেম্বরের ভোটেই জানা যাবে, কে জয়ী। তার আগ পর্যন্ত আমরা শুধু সন্দেহ করতে পারি। তা সত্ত্বেও মানুষ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করতে পারে। এ ব্যাপারে তেমন সন্দেহ নেই যে এই নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে যাবে, যার সরকারেরও পরিণতি একই হবে, তা সে যেই প্রেসিডেন্ট হোক বা যে পার্টি কংগ্রেসের উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাক না কেন। কথা হচ্ছে, ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিক কেউই নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, যদি না তারা একে অপরকে কিছু সাহায্য করে।

 
কিন্তু কারও এটা ভাবা ঠিক নয়, মার্কিন রাজনীতি শুধু ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান শিবিরেই বিভক্ত। বস্তুত, এই দুই দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজনও দ্বিদলীয় বিবাদের মতোই গভীর। দুই দলের মধ্যেই বড় ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ একটি গোষ্ঠী আছে, যারা দলকে একটি চরম জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের মধ্যকার চরমপন্থী অংশটি দলকে বামপন্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, আর রিপাবলিকানদের চরমপন্থী অংশটি দলকে চরম ডানপন্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে তাদের পক্ষে একটা মধ্যপন্থা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে ওঠে।

 
এদিকে নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রাজনীতি দ্রুত শুরু হয়ে গেলে আপস-মীমাংসা করা কঠিন হয়ে যাবে। যদি হিলারি ক্লিনটন জেতেন, তাহলে হয়তো দেখা যাবে, রিপাবলিকানরা মনে করবে, শুধু ট্রাম্পের ভুলের কারণেই এমনটা হয়েছে। তারা ভাববে, হিলারি সম্ভবত একবারের জন্যই প্রেসিডেন্ট হবেন। তারা ভাববে, যে দেশটি পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে, সে দেশ পরপর চারবার ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট রাখবে না। অনেক রিপাবলিকান (বিশেষ করে, যাঁরা তাঁর বিজয়ের বৈধতা মানতে চাইবেন না) হয়তো তাঁর প্রশাসনকে হতাশ করার চেষ্টা করবেন, যাতে তিনি ২০২০ সালে সফলতাপ্রাপ্ত সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবারও নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারেন। একইভাবে যদি ট্রাম্প জিততে পারেন, তাহলে অধিকাংশ ডেমোক্র্যাটই (সঙ্গে অনেক রিপাবলিকানও থাকবেন) এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন, যাতে ট্রাম্প দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ না পান। তখন এটাই হবে তাঁদের প্রধান কাজ। কথা হচ্ছে, ট্রাম্পের নীতিপ্রণেতাদের কাছে তাঁর অনেক অ্যাজেন্ডাই আপত্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁর আমলে শাসন পরিচালনা করাই কঠিন হয়ে যাবে।

 
উভয় ক্ষেত্রেই আবার কিছু বিষয়ে অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হবে। দেশটির আগামী সরকার হয়তো আইন করে সেখানকার পুরোনো অবকাঠামোগত নবায়নে অর্থায়ন করতে পারে। উভয় প্রার্থী ও কংগ্রেসের অনেক সদস্যই এটা পছন্দ করবেন। আবার দেশটির রাজস্ব–ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার পক্ষেও হয়তো কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া যেতে পারে: করপোরেশনের উচ্চ কর হার কমিয়ে সম্পদশালী ব্যক্তিদের কর বাড়ানো। এমনকি স্বাস্থ্য খাতেও কিছু সংস্কার আনা যেতে পারে, যেটা ছিল বারাক ওবামার মূল অর্জন। যদিও বিদ্যমান ব্যবস্থায় এর বাস্তবায়ন কঠিন ছিল।

 
আর অন্য যেসব বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে সহযোগিতার প্রয়োজন হবে, সেগুলো শিগগিরই আমলে নেওয়া হচ্ছে না, সম্ভবত এর একটি হচ্ছে অভিবাসন–ব্যবস্থার সংস্কার। এটা যেমন যুক্তরাষ্ট্রে খুবই বিতর্কিত ব্যাপার, তেমনি ইউরোপেও। আরেকটি হচ্ছে বাণিজ্য। কারণ, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে নীতিপ্রণেতারা এমন অবস্থান নিতে ভয় পান, যার কট্টর বিরোধী গোষ্ঠী সৃষ্টি হতে পারে। কথা হচ্ছে, ট্রাম্প ও হিলারি উভয়েই ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপের বিরোধী, যদিও যুক্তরাষ্ট্র তা অনুসমর্থন করলে তার অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সুবিধা হবে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি ও ঋণ উভয়ই বাড়তে পারে, কারণ তার অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় কমানোর তেমন ইচ্ছা নেই।

 
তবে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন নির্বাচনের প্রভাব কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। কারণ, মার্কিন সংবিধান অনুসারে তাদের প্রেসিডেন্টের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার আছে। আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি অনুসমর্থন করা বা যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার কংগ্রেসের। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের সুনির্দিষ্ট অনুমোদন ছাড়াও সামরিক বলপ্রয়োগ করতে পারেন। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট চুক্তি ব্যতীত আন্তর্জাতিক মতৈক্য, হোয়াইট হাউসের ক্ষমতাধর কর্মী নিয়োগ ও নির্বাহী ক্ষমতার বলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বদলে দিতে পারেন। সম্প্রতি কিউবার বেলায় ওবামা যেটা করেছেন।

 
হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হলে এই বিশেষাধিকার প্রয়োগের ফলাফল এমন হতে পারে: সিরিয়ায় এক বা একাধিক নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠা করা, ইউক্রেনকে আরও আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ, উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ায় তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ। তবে নির্বাচিত হলে ট্রাম্প কী করতে পারেন, তা ধারণা করা আরও কঠিন। তারপরও ধারণা করা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু প্রথাগত মিত্রের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনবে, আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে দূরে থাকবে।
নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রে কী হবে, প্রশ্ন হিসেবে তা উন্মুক্ত প্রকৃতির, যদিও কিছু ধারণা করা যায়। কিন্তু একটি কথাই শুধু নিশ্চিত করে বলা যায়: বিশ্বের ৯৬ শতাংশ মানুষ এ নির্বাচনে ভোট না দিলেও মার্কিন নাগরিকদের মতো তারাও এর প্রভাব অনুভব করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
রিচার্ড এন হাস: কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট।

সূত্র: প্রথম আলো