নিরাপদ সড়কের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ চাই

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশে ষষ্ঠবারের মতো আজ ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০২২ পালন করা হবে। দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলাই এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য।

২০ বছর ধরে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে। বিষয়টি এখন অনেকটাই জাতীয় সড়ক দুর্যোগে রূপ নিয়েছে।

দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শোনা গেলেও দিন দিন সংকট বাড়ছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো মানদণ্ডেই সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে বাংলাদেশের সূচকের উন্নতি হয়নি। বরং অবনতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। অথচ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি যানবাহন যেসব দেশে চলে সেখানেও কিন্তু এত দুর্ঘটনা হয় না। প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি।

ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ১৬০ বর্গফুট জায়গা নেয় এবং বাইরে যতক্ষণ থাকে তার ৯০ শতাংশ সময় পার্ক করা থাকে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’ কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী যানজটের দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান প্রথম। ২০১৮ সালে এর অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। মাত্র তিন বছর আগেও ঢাকা তৃতীয় স্থানে ছিল।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে মৃত্যু ১২ হাজার। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ছয় হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছে সাত হাজার ৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী।

সংগঠনের হিসাবে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ, আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। তাদের হিসাবে প্রতিদিন সড়কে ১৭ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর যত দুর্ঘটনা ঘটেছে তার ৬২ শতাংশের কারণ যানবাহনের বেপরোয়া গতি।

এ ছাড়া চালকদের অদক্ষতা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের চলাচল, ফুটপাত হকারের দখলে থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে।

অথচ ভারতে প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের বিপরীতে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে, আর বাংলাদেশ তা ৪৫।

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বে সড়কপথে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। দেশে সড়কপথে চলাচলরত প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রাণহানি ঘটে ২৮৭ জনের। এদিক থেকে বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে কেবল জিম্বাবুয়ে। দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২১৭ জনের। এর বাইরে আর কোনো দেশে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় এত বেশি প্রাণহানির নজির নেই। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোড সেফটি সংক্রান্ত সাম্প্র্রতিক সময়ের প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

বিশ্বব্যাংকের ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় চলাচলরত প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে যথাক্রমে ৮৭ ও ৮ জনের।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাসের দায় ২৬ শতাংশ হলেও বিশ্বের অন্য কোনো দেশে তা ১৫ শতাংশের বেশি নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০১৮ প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী বাস দুর্ঘটনাপ্রবণ অন্য দেশগুলোর মধ্যে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ায় এ হার ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া ঘানায় ১৩ শতাংশ, কাতারে ১২, বারবাডোজে ১১, মালিতে ১০, আইভরি কোস্টে ৮ ও কিউবায় ৭ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ হার কমবেশি ১ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বাস দুর্ঘটনা কিভাবে কমানো যায় এ নিয়েও ভাবনা জরুরি।

দেশে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কের বিপরীতে কত যানবাহন চলতে পারে এ ধরনের কোনো হিসাব ছাড়াই যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন রাস্তায় নামছে পাঁচ শতাধিক নতুন যানবাহন। নিবন্ধিত ৫৪ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৭০ শতাংশই হলো মোটরসাইকেল। প্রায় ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে এই যানে। বিপজ্জনক এই যানে একটি দেশের মূল জনশক্তি হিসেবে বিবেচিত তরুণদের মৃত্যু আশঙ্কাজনক বাড়ছে, যা সত্যিই বড় রকমের উদ্বেগের কারণ। তাই এই মৃত্যুযান নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।

সারা দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফা আন্দোলনের পর সরকার সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে পরামর্শ দিতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি পুরনো সুপারিশের আলোকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১১১ দফা সরকারের কাছে জমা দেয়। সুপারিশে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানামুখী প্রকল্প নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা ছিল।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কয়েকটি নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেসব নির্দেশনা কি মেনে চলা হচ্ছে? তাহলে কি সড়ক নিরাপত্তা দেখার কেউ নেই? নিরাপদ সড়ক নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তই আর আলোর মুখ দেখবে না? সবচেয়ে বড় কথা হলো, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এখন পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যকর করা গেল না। আইনের শাস্তিযোগ্য প্রায় ২৯টি ধারা নিয়েই আপত্তি জানিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। শোনা যাচ্ছে সড়ক আইনে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান থাকছে না।

সড়ক নিরাপত্তার জন্য সব সিদ্ধান্ত একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে না। কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলেই কিন্তু পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ঘটানো যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সবার আইন মানা বাধ্যতামূলক করতে হবে অর্থাৎ আইন সবার জন্য সমান। চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো যানবাহন চলতে দেওয়া যাবে না। নিষিদ্ধ যান চলাচল বন্ধ ও উৎপাদন বন্ধের বিকল্প নেই। মোটরসাইকেল চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। চালক ও শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও ট্রাফিক আইন, দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং সড়কের সাইন সিগন্যাল সম্পর্কে আলাদা প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সড়কের কারিগরি ত্রুটি দূর করতে রাস্তা সংস্কার করতে হবে। স্পিড গান বাড়ানোসহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রুতগতির যান চলাচল রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

জনবল বাড়িয়ে বিআরটিএকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম আরো স্পষ্ট করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কের দুই পাশে অবৈধ বাজারসহ সব রকমের স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে সভা, সেমিনার, পথনাটক, পোস্টার, লিফলেট বিতরণসহ প্রচার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। মর্যাদা বাড়িয়ে শিক্ষিত বেকারদের চালকের পেশায় নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

প্রয়োজনে পাঠ্যপুস্তকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতামূলক বিষয় যুক্ত করা যেতে পারে। যেখানে-সেখানে গাড়ি থামানো বন্ধ, পরিবহন শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সর্বোপরি সড়ক আইন-২০১৮ কার্যকর করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সড়ক দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।

লেখক : সাংবাদিক
rajan0192@gmail.com

 

 

সূত্রঃ কালের কন্ঠ