নিম্নমাণের খাবারে আশানরুপ যাত্রী পাচ্ছে না বিরতিহীন বনলতা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নিম্নমাণের খাবার বাধ্যতামূলক করায় যাত্রী হারাচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলবাসীর বহুল কাঙ্খিত ট্রেন বনলতা এক্সপ্রেস। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা বনলতা ট্রেনটির যাত্র, ট্রেনের গার্ড, টিটি, এ্যাটেন্ডেন্ট এমনকি দায়িত্বরত রেল পুলিশ সদস্যদেরও একই কথা এটি।
তাদের ভাষ্য, অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বনলতার উদ্বোধন করা হয়। যাত্রীদেরো এই ট্রেন নিয়ে ব্যাপক আকাঙ্খা ছিলো। কিন্তু টিকিটের সঙ্গে বাধ্যতামূলক ১৫০ টাকা খাবারের মূল্য জুড়ে দেয়ায় সেই আগ্রহ ধুলোই মিশে যেতে বসেছে।
কারণ ট্রেনটির অধিকাংশ যাত্রীই মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাদের কাছে ১৮৫ টাকা সাশ্রয় অনেকটায় বড় পাওয়া। বিরতিহীন ট্রেনটিতে দেড় ঘন্টা সময় বাঁচাতে গিয়ে ১৮৫ টাকা গোচ্চা দিতে চাচ্ছেন না এসব যাত্রীরা। ফলে প্রতিদিনই রাজশাহী থেকে শোভন চেয়ারের প্রায় অর্ধেক ফাঁকা পড়ে থাকছে। গতকালো ছিলো এমন দশা।
রেলের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের হিসেব অনুযায়ী, রাজশাহী থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাতটায় ছাড়ে বিরতিহীন বনলতা। নির্দিষ্ট সময় মতোই ছাড়ে ট্রেনটি। কিন্তু গতকালো এর ২৪০টি আসন ফাঁকা ছিলো। এছাড়াও টিকিটছাড়ায় আরো কিছু যাত্রী ট্রেনে উঠে পড়ায় কিছু আসন পূর্ণ হয়। না হলে ফাঁকার সংখ্যা ৩০০ পার হয়ে যেত। অনেকেই টিকিট কাটার সময় না পেয়ে তড়িঘড়ি করে ট্রেনে উঠে পড়েন। পরে জরিমানাসহ ওই যাত্রীদের টিকিট দেয়া হয়। এ কারণে কিছুটা যাত্রী বাড়ে।
ট্রেনটির খ বগির যাত্রী ছিলো এই প্রতিবেদক। এসি স্নিগ্ধা বগিটির প্রতিটি আসনই ছিলো পরিপূর্ণ। কিন্তু বগিটির সামনেকার ক বগিটিতেই ১১ টি আসন ফাঁকা ছিলো। এটি ছিলো সাধারণ শোভন চেয়ারের বগি।
আবার এসি স্নিগ্ধা গ বগিটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেটিও পরিপূর্ণ ছিলো যাত্রীতে। কিন্তু পরের শোভন চেয়ারের ঘ বগিতে ছিলো ৫টি আসন ফাঁকা। ওই বগির পরে চ বগিটি ছিলো পাওয়ার কার। তার পরেই ছ বগিতে ৯২ টি আসনের ৪১ টিই ফাঁকা ছিলো।
এই বগির যাত্রী ছিলেন হাসান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, এতো বড় বগি, যাত্রী কয়জন দেখেন। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বাধ্য হয়ে এই ট্রেনে যাচ্ছে। জরুরী প্রয়োজনে যাচ্ছি। দেড় ঘন্টা সাশ্রয় হবে। কিন্তু এই দেড় ঘন্টা সাশ্রয় করতে গিয়ে ১৮৫ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। কারণ বনলতার পরেই রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাওয়া সিল্কসিটি ট্রেনের শোভন চেয়ারের টিকিটের মূল্য ৩৪০ টাকা। ওই টেন ৬ ঘন্টার মধ্যেই ঢাকায় পৌঁছায়। সেই হিসেবে দেড় ঘন্টা বাঁচাতে গিয়ে অতিরিক্ত ১৮৫ টাকা ব্যয় হচ্ছে বনলতায়।’
এই বগির আরেক যাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাসিবুর রহমান বলেন, বুধবার ছুটিতে বাড়ি গেছিলাম। বৃহস্পতিবার দুপুরে একটা টিউশনি আছে। তাই তড়িঘড়ি করে বনলতার শোভন চেয়ারের টিকিট কেটেছি। ঢাকায় যেনো দুপুরের মধ্য ফিরতে পারি। এই কারণেই অতিরিক্ত টাকা লাগলেও বাধ্য হয়েছি এই ট্রেনে আসতে। বরারবরই ট্রেনে যাতায়াত করি স্বাচ্ছন্দবোধ করি তাই। কিন্তু বনলতাই টিকিট কেটে ১৮৫ টাকা বেশি খরচ হলো। যে টাকা দিয়ে হয়তো দুপুরের খাবারটা বাইরে ভালোভাবেই হয়ে যেত। সিল্কসিটিতে আসলে ৩৪০ টাকাতেই আসতে পারতাম। এ কারণেই হয়তো আমার মতো সাধারণ যাত্রী বা শিক্ষার্থীরা বনলতায় আগ্রহ হারাচ্ছে।’
হাসিবুর বলেন, ‘রাজশাহী-ঢাকা রুটে বিপুল পরিমাণ ট্রেনযাত্রী হলো আমার মতো শিক্ষার্থী। যারা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা বড় বড় স্কুলেও পড়া-শোনা করে। এসব শিক্ষার্থীরা ছুটিতে বাড়িতে যাতায়াত করে। তাদের কথা বিবেচনা করে অন্তত বনলতা ট্রেনের খাবার বাধ্যতামূলকের বিষয়টি রেল কর্তৃপক্ষের প্রত্যাহার করা উচিত। তা না হলে ক্রমেই আরো যাত্রী হারাবে বহুল প্রত্যাশিত এই ট্রেনটি। কারণ এখন শুরুতেই অনেক সাধারণ যাত্রী কৌতুহলবশত এই ট্রেনে চড়ছে। কিন্তু দুদিন পরে এই কৌতুহল যখন থাকবে না, তখন কি হবে? ট্রেনটি তখন আরো লোকসানের মুখে পগবে চরমভাবে। তখন এ ছুতোতে না বন্ধ হয় যায় বনলতা ট্রেনটি। হয়তো এ চক্রান্তই হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। যার জন্য যাত্রীরা না চাইলেও ১৫০ টাকার নামমাত্র নিম্নমাণের খাবার দেয়া হচ্ছে জোর করে।
ট্রেনের জ বগিটিও শোভন চেয়ারের। এই বগির যাত্রী ছিলেন, রাজশাহীর বৈকালী সংঘ স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রইচ উদ্দিন বাবু। তিনি ছেলে অন্ততকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। ব্যক্তিগত জরুরী কাজে ঢাকায় আসতে হয়েছে তাকে। তবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ায় ছেলে অন্ততও বাবার সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছেন।
রইচ উদ্দিন বাবু বলেন, ‘খাবার বলতে একটা সিঙ্গাড়া, হাঁফ লিটার পানি, একটা বার্গার আর এক পিচ কেক। সঙ্গে প্যাকেটজাত করা শস। এই খাবারের দাম বড় জোর রাজশাহীতে ৭৫-৮০ টাকা। কিন্তু সেই খাবারের জন্যই টিকিটের সঙ্গে কেট নেয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা। যেনো জোচ্চুরি ছাড়া কিছুই নয়। আবার সকালেই যেসব গ্যাস্ট্রিকের রোগী খালি পেটে এসব খাবার খাবেন, তারা নিশ্চিত বিপদে পড়বেন। আমারো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে, তাই মুখেও তুলিনি এই খাবার।’
জ বগি পার হয়ে ঝ বগিতে গিয়ে দেখা যায়, ৯২ আসনের ১২টিই ফাঁকা।
এই বগির যাত্রী একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষার্থী হুমাইরা আক্তার বলেন, এসির টিকিট পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে শোভন চেয়ারেই যাচ্ছি। তবে ট্রেন হিসেবে টিকিটের মূল্য ঠিক থাকলেও খাবারের মাণ একেবারেই খারাপ। যেসব খাবার দেয়া হয়েছে তার মধ্যে বার্গারটি মুখেই তুলিনি। অনেকেই দেখছি সিঙ্গাড়াও খাচ্ছে না। এই খাবারের ১৫০ টাকা দাম ধরা মোটেই ঠিক হয়নি। এ কারণেই হয়তো শোভন চেয়ারের যাত্রী পাচ্ছে না বনলতা। কিন্তু সিল্কসিটি, পদ্মা বা ধুমকেতুতে তো ঠিকই যাত্রী হচ্ছে এখনো।’
ঝ বগি পার হয়ে ঞ বগিতে যেতেই দেখা গেলো প্রায় পুরো বগিটিই যেনো ফাঁকা। মাঝেকার তিনটি আসন একাই দখল করে ঘুমাচ্ছে একটি শিশু। দেখে মনে হলো, পথশিশু। তার পেছনের কয়েকটি চেয়ারে বসে আছেন জনা কয়েক যাত্রা। সবমিলিয়ে এ বগিতে যাত্রীসংখ্যা ছিলো ৩৯ জন। ফাঁকাই ছিলো ৫৩টি।
এই বগির যাত্রী ছিলেন রাজশাহীর কাটাখালি পৌরসভার সচিব সিরাজুম মনির। তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর সিটির একটি কর্মশালায় যোগ দিতে যাচ্ছি। ১২টায় ওই কর্মশালা শেষে আবার রাতে রাজশাহী ফিরবো। তাই এ ট্রেনে যাচ্ছি। কিন্তু ট্রেনে উটেই তো মন খারাপ। আশ-পাশে তেমন যাত্রী নাই। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। গল্প করারও তেমন লোক নাই। অথচ রাজশাহী-ঢাকা রুটের অন্য ট্রেনগুলোর বগিতে ধাপ ফেলারো জায়গা থাকে না। বিশেষ করে সকালে এবং রাতে। কিন্তু এখানে উল্টো চিত্র। অথচ এই ট্রেনটি নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু  আসন ফাঁকা দেখে মনের মাঝে আতঙ্ক দানা বাঁধছে যে, যাত্রী না পাওয়ায়র ছুঁতোই না বন্ধ করে দেয়া হয় স্বপ্নের ট্রেনটি।’
সিরাজুম মনির বলেন, ‘যে মাণের খাবার দেয়া হয়েছে, তা মুখেই তুলেনি। এই খাবারের দাম নিয়েই সাধারণ যাত্রীদের নাকি আপত্তি? আর সে কারণেই নাকি যাত্রী হচ্ছে না শোভন চেয়ারে।’
বিষয়টি স্বীকারো করলেন, ট্রেনে দায়িত্বরত একজন এটেন্ডেন্ট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, খাবারের দামের কারণেই বনলতায় শোভন চেয়ারে যাত্রী হচ্ছে না। প্রতি বারই বিপুলসংখ্যক আসন ফাঁকা থাকছে। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের বিপুল পরিমাণ লোকসান হবে। অথচ সিল্কসিটি, পদ্মা ও ধূমকেতুতে টিকিট পাচ্ছে না যাত্রীরা।’
ট্রেনের আরেক এটেন্ডেন্ড মামুন অর রশিদ বলেন, আমার হিসেব মতে বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনে ২৪০ টি আসন ফাঁকা ছিলো। এর বাইরে আরো কিছু যাত্রী টিকিট ছাড়ায় উঠে পড়ে। তাদের পরে জরিমানাসহ টিকিট দেয়া হয়। সেই হিসেবে অন্তত ৩০০টি আসন ফাঁকা থাকতো না হলে। এভাবে প্রতি বারই বনলতায় আসন ফাঁকা থাকছে।’
ট্রেনের এটেন্ডেন্ট এসএমএ মালেক জানান, বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী থেকে ৬৬৮ যাত্রী ছিলো মোট। আগের দিন বুধবার সকালে ছিলো ৮৪৪।
ট্রেনের টিটি সুমন হোসেন বলেন, খাবার মূল্য বাদ দিলে যদি ২৪০ আসন ফাঁকা থাকে, তাহলে ৩৭৫ টাকা টিকিট মূল্য ধরে অন্তত ৯০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে বৃহস্পতিবার। তবে আশা করছি হয়তো দ্রুতই যাত্রী সংখ্যা বাড়বে শোভন চেয়ারেও। যদিও শুরু থেকেই এসি চেয়ারে টিকিট পাচ্ছে না যাত্রীরা।’
ট্রেনের এসি স্নিগ্ধার যাত্রী এ্যাডভোকেট আরমান আলী বলেন, ট্রেনে বসে খাবার পাচ্ছি এটা বড় বিষয়। তবে মাণটা আরো ভালো হলে  অনেক ভালো হতো। আবার খাবারের বিকল্প কোনো খাবার নাই। যে কারণে খাই না খাই একই খাবার নিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। কিন্তু বিকল্প খাবার থাকলে হয়তো যাত্রীরা তার পছন্দমতো খাবির নিতে পারতো বা খেতে পারতো। ফলে যে খাবার রেলকর্তৃপক্ষ দিচ্ছে তার সিংহভাগই নষ্ট হচ্ছে বা কোনো কাজে আসছে না যাত্রীদের। কারণ সকালে বা ঢাকা থেকে রাজশাহী যাওয়ার সময় দুপুরের এই সময়ে বার্গার, সিঙ্গাড়া এ কেক অনেকেই পছন্দ করেন না।’
এদিকে জানা গেছে, বনলতা এক্সপ্রেসে আছে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা ১২টি নতুন বগি। অত্যাধুনিক এ ট্রেনে শোভন চেয়ারের বগি ৭টি। যার আসন সংখ্যা ৬৬৪টি। এসি বগি ২টি। যার আসন সংখ্যা ১৬০টি। একটি পাওয়ার কারের আসন সংখ্যা ১৬টি। দুটি গার্ডব্রেকের আসন সংখ্যা ১০৮টি। সবমিলিয়ে বনলতায় মোট আসন থাকছে ৯৪৮টি। আর সবমিলিয়ে যাত্রীর আসনসংখ্যা ৯২৪টি।
গত ২৫ এপ্রিল থেকে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টার ও অনলাইন থেকে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে এ ট্রেনের।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের সুপারিনডেন্ট আমজাদ হোসেন জানান আরো, সবার চোখ এসি চেয়ারের টিকিটের দিকে। কিন্তু শোভন চেয়ারের টিকিট খুব বেশি বিক্রি হচ্ছে না। এ কারণে প্রায় সব ট্রেনেই আসন ফাঁকা থাকছে। তিনি জানান, আগামী ৮ মে পর্যন্ত এসির কোনো টিকিট নাই। কিন্তু বৃহস্পতিবারের শোভন চেয়ারের টিকিও আছে। এমনকি গতকাল শুক্রবার সকালেও বেশকিছু আসন ফাঁকা গেছে।
স/আর