নিত্য বিকল ইঞ্জিন ট্রেনযাত্রায় আতঙ্ক

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

 

রেলওয়েতে সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও নিরাপদ যান হিসেবে পরিচিত ‘সোনার বাংলা’ এক্সপ্রেস ট্রেন। কিন্তু এ ট্রেনটি যখন চলন্ত অবস্থায় বিকট শব্দে হেলেদুলে দাঁড়িয়ে যায়, তখন চরম আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন যাত্রীরা।

চিৎকার শুরু করেন নারী-শিশুরা। ২২ মে এ ট্রেনটি বিমানবন্দর রেলস্টেশন আউটারে বিকল হয়। এতে দুই ঘণ্টা বিলম্বে ট্রেনটি গন্তব্যে পৌঁছে।

শুধু সোনার বাংলা নয়, সিল্কসিটি, সুবর্ণ, তূর্ণাসহ আন্তঃনগর, মেইল ও লোকাল ট্রেনগুলোরও একই অবস্থা। পুরনো ইঞ্জিন নিয়ে চলার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে।

ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনায় আতঙ্কিত যাত্রীদের সঙ্গে শঙ্কায় রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষও। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনায় ট্রেন পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় নতুন ইঞ্জিন ও বগি না মিললে ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা বাড়তেই থাকবে। বর্তমান সরকারের আমলে নতুন বগি ও ইঞ্জিন ক্রয় না করলে সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করত।

রেলওয়ে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রেলওয়েতে বর্তমানে ২৭২টি ইঞ্জিন রয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ ইঞ্জিনের মেয়াদ রয়েছে।

বাকি ইঞ্জিনগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ। এক একটি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১৮ থেকে ২০ বছর হয়। কিন্তু রেলওয়েতে এখন প্রায় ৮৫ শতাংশ ইঞ্জিন আয়ুষ্কাল পেরিয়ে ৬০ থেকে ৭০ বছরে গিয়ে ঠেকেছে।

এসব ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে! ফলে উনিশ থেকে বিশ হলেই চলমান ট্রেনগুলোর ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন ইঞ্জিন রেলওয়ে বহরে যুক্ত না হলে ট্রেন পরিচালনা বন্ধ হয়ে পড়তে পারে।

আগামী আড়াই থেকে সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে নতুন ইঞ্জিন যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। ফলে ইঞ্জিন ফেলের সঙ্গে ট্রেন পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, পূর্বাঞ্চল রেলপথে প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো ট্রেনের ইঞ্জিন ফেল হচ্ছে। এ অঞ্চলে ২৩ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করছে।

তা ছাড়া লোকাল ও মেইল ট্রেনের সংখ্যা ২৪টি। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়া বাকি ট্রেনগুলো নির্ধারিত আসন সংখ্যার বাইরে প্রায় ২-৩ গুণ যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। এতে অতিরিক্ত যাত্রীবহন ও আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া ইঞ্জিনগুলোর ফেল’র সংখ্যা বাড়তে থাকে।

প্রতিদিনই কোনো না কোনো ট্রেনের ইঞ্জিন ফেল’র হচ্ছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত এ অঞ্চলে মোট ২০৩ বার ইঞ্জিন বিকল বা ফেল’র ঘটনা ঘটে। যা গত বছর ছিল ৯৭ বার। এক একটি ইঞ্জিন ফেল’র ঘটনায় ১ ঘণ্টা থেকে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, নতুন ইঞ্জিন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে নতুন বগিও আনা জরুরি। পুরনো ইঞ্জিন-অধিকাংশ বগি দিয়ে ট্রেন পরিচালনা ঠিক রাখতে হচ্ছে। ফলে ইঞ্জিন ফেল’র সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

বর্তমান রেলপথমন্ত্রী রেলওয়ের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন ইঞ্জিন আসবে, দুই-আড়াই বছরের মধ্যে ইঞ্জিন চলে আসবে।

আমরা কিন্তু প্রতিনিয়ত ইঞ্জিন মেরামত করে ট্রেন চালাচ্ছি। নতুন ইঞ্জিনের সঙ্গে নতুন বগি রেলওয়ে বহরে যুক্ত হলে সমস্যা থাকবে না। মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিন নিয়ে আর পারছি না। ৬০-৭০ বছরের পুরনো ইঞ্জিনও চালানো হচ্ছে। আমার অঞ্চলে ১৫০টি ইঞ্জিন ও ৯৩০টি বগি রয়েছে। মাত্র ৩৯টি ইঞ্জিন পুরোপুরি সক্ষম রয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পূর্বাঞ্চল বাণিজ্যিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ট্রেন সিডিউল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইঞ্জিন ফেল’র ঘটনা।

নির্ধারিত গতিতে দু-একটি ট্রেন ছাড়া আর কোনো ট্রেনই চালানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নতুন রেলপথ, রেলওয়ের উন্নয়নের সুফল সাধারণ যাত্রীরা যথাযথ পাচ্ছেন না। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে রেলওয়েতে আমূল পরিবর্তন আসবে।

শত উন্নয়নের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে নতুন ইঞ্জিন ও বগি কেনার বিষয়টি। একই সঙ্গে রেলওয়ের ওয়ার্কশপগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

ইঞ্জিন ফেল’র কারণে আয় যেমন কমছে, তেমনি অনেক সময় ট্রেনের যাত্রা বাতিলও করতে হচ্ছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে মোট ১২২টি ইঞ্জিন রয়েছে।

এ অঞ্চলে চলা ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে মাত্র ১৩ থেকে ১৫ শতাংশের আয়ুষ্কাল রয়েছে। ব্রডগেজের ইঞ্জিন রয়েছে ৯৪টি আর মিটারগেজের ইঞ্জিন ২৮টি। মোট বগির সংখ্যা ৬৩০টি। ৪২৮টি ব্রডগেজ ও ২১২টি মিটার গেজ। এসব বগির প্রায় ৬৫ শতাংশই মেয়াদ উত্তীর্ণ। এ অঞ্চলে পুরোপুরি সক্ষম ইঞ্জিন রয়েছে মাত্র ২৬টি। ১৯৫৩ সালের ইঞ্জিন এখনও চালানো হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই ১ তারিখ পযর্ন্ত এ অঞ্চলে ১৫৪ বার ইঞ্জিন ফেল’র ঘটনা ঘটেছে, যা গত বছরের তুলনায় ৫০টি বেশি।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মৃনাল কান্তি বণিক যুগান্তরকে বলেন, ‘একের পর এক ইঞ্জিন ফেল’র মধ্য দিয়েই আমরা ট্রেন পরিচালনা ঠিক রাখছি। আমাদের দক্ষ শ্রমিক রয়েছে, রাতদিন তারা মেরামতের কাজ করছেন। মেয়াদ উত্তীর্ণ এসব ইঞ্জিন মেরামত করে ঠিক না রাখলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়বে।’

তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে মোট ১২২টি ইঞ্জিনের মধ্যে ৯৪টি ব্রডগেজ এবং ২৮টি মিটার গেজ ইঞ্জিন। ৩৯টির আয়ুষ্কাল রয়েছে বাকি ইঞ্জিনগুলোর আয়ুষ্কাল নেই। ৭০ বছর পুরনো ইঞ্জিন মেরামত করে চালাতে হচ্ছে। ৪০টি ইঞ্জিন ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত ইঞ্জিন না আনা হলে ইঞ্জিন ফেল’র ঘটনা চরমে উঠবে। আমরা ইঞ্জিন মেরামত করতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাচ্ছি না। পাকিস্তান-ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব ইঞ্জিন ৪০-৫০ বছর আগেই জাদুঘরে রেখে দেয়া হয়েছে, আর আমরা এখনও চালাচ্ছি। এ জন্য আমাদের কেউ বাহবা দেয় না। প্রশংসা করে না।’ তিনি বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় এসব ইঞ্জিন যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন দেশে যন্ত্রাংশ খুঁজতে গেলে তারা আচার্য্য হয়, কি করে এসব ইঞ্জিন বাংলাদেশে চালিয়ে রাখা হচ্ছে।

এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রেলওয়েতে যাত্রীসেবা বাড়ানোসহ আরও নতুন ট্রেন পরিচালনার জন্য ১ হাজার ১৬৫টি নতুন ইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী বগি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ৪০টি ব্রডগেজ, ৭০টি মিটারগেজ, ৫০টি ব্রডগেজ ভ্যান সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া ৪শ’টি মিটারগেজ ও ৩শ’টি ব্রডগেজ বগি কভার্ড ওয়াগন এবং ১৮০টি এমজি ও ১২০টি বগি ওয়াগন কেনা হবে।

দ্রুত সময়ের মধ্যে রেলওয়ে বহরে নতুন ইঞ্জিন ও বগি আনতে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়টি নিয়ে শুধু রেলপথমন্ত্রী নয়, মাঠ পর্যায়ের রেলওয়ে কর্মকর্তাসহ সব কর্মকর্তাকে তৎপর হতে হবে।

এ বিষয়ে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) শামসুজ্জামানের সঙ্গে বুধবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন কথা বলেন। জানতে চাওয়া হয় বর্তমান সরকারের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্প ও বিশেষ করে ইঞ্জিন ও বগি ক্রয়ের বিষয়ে। এ সময় তিনি জানান, সবকিছু তিনি বলতে পারবেন না।

রেলপথ নির্মাণ, ইঞ্জিন-বগি ক্রয়ের বিষয়টি নিয়ে আপনি কাজ করেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বললাম তো আমি কিছু বলতে পারব না। এসব প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক যারা রয়েছে তাদের কাছে গিয়ে জানুন।’ ১০টি মিটারগেজ ও ৪০টি ব্রডগেজ ক্রয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাখেন, আমি বলতে পারব না।’

এ বিষয়ে তার সমমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, রেলপথ মন্ত্রণালয় তথা রেলওয়েতে নেয়া উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে জনসাধারণকে জানানো তার (শামসুজ্জামান) নৈতিক দায়িত্ব। তিনি তা করছেন না কেন, তিনিই ভালো জানেন।