‘নিজ দেশে জনকল্যাণে তথ্য-প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চাই’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

‘এই যে খিদে লাগলে আপনি খাবার খান, এই যে কাপড় পরেন কিংবা ঘুমান…ঠিক এভাবেই প্রযুক্তিটাকে মানুষের জীবনের অংশ বানিয়ে দিতে চাই আমি। আমার স্বপ্ন-ধ্যান-জ্ঞান সবই একে নিয়ে। বহু বছর ধরে আইটি খাতে ঘাম ঝরিয়েছি আমি। এবার আমার দেশের জনকল্যাণে একে কাজে লাগাতে চাই’, জ্বলজ্বলে চোখে স্বপ্ন নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ড. শাহ জাহান মিয়া। তথ্য-প্রযুক্তি দুনিয়ায় তিনি শাহ মিয়া নামে সুপরিচিত। গাইবান্ধার ফুলছড়ি গ্রামের সাধারণ এক ছেলে আজ তথ্য-প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক দ্যুতি ছড়ানো ব্যক্তিত্ব। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে স্বপরিবারে থাকেন। কিন্তু প্রায়শই তাঁর মন ও মস্তিষ্ক ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে।

সম্প্রতি দেশে এসেছেন তিনি। গাইবান্ধায় অসুস্থ বাবার পাশে সময় কাটিয়েছেন। আবার কাজের খাতিরে চলে যেতে হবে। যাওয়ার আগে মনের মাঝে জিইয়ে রাখা কিছু ইচ্ছার কথা জানালেন প্রযুক্তিবিদ।

তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম। আপনি আইটি খাতে বাংলাদেশের জন্যে কী করতে চান?

সহজ করে জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। বললেন, ‘আমি আইটি সংক্রান্ত পুরো জ্ঞানকে মানবকল্যাণে কাজে লাগাতে চাই। আর এর জন্যে আমার দেশ সর্বোত্তম স্থান বলে মনে করি। অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমার সৃষ্ট থিওরি বা সিস্টেমে দিব্যি সুফল পাচ্ছেন সেখানকার মানুষ। অথচ তাদের তুলনায় প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে থাকা নিজের দেশের জন্যে অনেক কিছুই করার আছে। আমার বানানো একটি সিস্টেম ২০০৭ সাল থেকে কুইন্সল্যান্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওটা কৃষকদের জন্যে বানিয়েছিলাম। এর মাধ্যমে তারা ব্যাপক উপকার পাচ্ছেন। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আমার ওই কাজটি ব্যাপক প্রচার পায়। ক্রমশই আমি নিজের দেশের জন্যে এসব করতে উৎসাহী হয়ে উঠি। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা কিংবা কৃষিখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার যদি সহজলভ্য ও ব্যবহারবান্ধব করা যায়, তবে কী হবে চিন্তা করুন! অ্যাপের মাধ্যমে সেবাগুলো অতি সহজে সরবরাহ করা সম্ভব। বাংলাদেশে এখনো কৃষকের কাছে প্রযুক্তির সুফল পৌঁছেনি। আমার মনে হয়, পিছিয়ে থাকা কৃষকদেরও প্রযুক্তির সুবিধা দেয়া উচিত। হয়তো এসব বিষয়ে স্বল্প পরিসরে সেবা দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। অতি সাধারণ মানুষের কাছেও যদি তা সহজ করে উপস্থাপন করা হয়, তবে ডিজিটালাইজেশনের কর্মযজ্ঞ পরিপূর্ণতা পাবে’।

বাংলাদেশ নিয়ে কোনো কাজ কি করেছেন…মানে অন্তত মূল কাজ শুরুর আগের কোনো কাজ?

‘আমি আসলে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে নিজেকে পুরোদস্তুর প্রযুক্তিবিদ বানিয়েছি। বিভিন্ন দেশে এসব নিয়ে কাজ করেছি। সেসব দেশে এগুলো প্রয়োগের বিস্তর সুযোগ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। নিজের দেশে এ ধরনের পদ্ধতিগুলো কাজে লাগানোর জন্যে ইতিমধ্যে গবেষণাকাজ শুরু করেছি। আমি বেছে বেছে গুটিকয়েক খাত নিয়ে ১০টি কেস স্টাডি সেরে ফেলেছি। ক্লাউড-ভিত্তিক দুটো সিস্টেম নিয়ে ৩ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। দেশে এগুলোর বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব’।

বলতে থাকলেন তিনি, ‘অন ক্লাউড মেটার্নিটি ক্লিনিক বা অন ক্লাউড হেলথ ক্লিনিক এর প্রায়োগিক সুফল মিলেছে। আমাদের দেশে মা হতে চলেছেন এমন কোনো দরিদ্র নারীকে পরিপূর্ণ এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা দেখা সম্ভব এসবের মাধ্যমে। স্বাস্থ্যগত নানা তথ্যও সরবরাহ করা যায়। সাধারণ মানুষের জন্যে প্রযুক্তিগত পদ্ধতি সহজ ও বোধগম্য করে বানাতে হবে। এসব অ্যাপের মাধ্যমে কৃষক থেকে শুরু করে একজন শিক্ষার্থীও অনায়াসে উপকার পেতে পারেন’।

জানালেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে প্রযোজ্য এমন ‘অন-ক্লাউড হেলথকেয়ার ক্লিনিক’ তৈরি করেছেন ড. শাহ মিয়া। এর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সেবা প্রদান সম্ভব। বিভিন্ন খাতে এমন অনেক কাজই তিনি তৈরি করে দিয়েছেন। এগুলোর প্রয়োগ বাংলাদেশেরও সম্ভব। ট্যুরিস্ট বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিস বিষয়ে ‘বিগ ডেটা অ্যানালিটিক্স মেথড’ তাঁরই তৈরি। অস্ট্রেলিয়া এর সুফল পাচ্ছে। সে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উদ্যোক্তাদের সহায়তায় তাঁর তেমন আরেকটি পদ্ধতিও আলোর মুখ দেখেছে। রাস্তাঘাটে চলাচলকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্লাউড-ভিত্তিক ডিএসএস মডেল করেছেন তিনি। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্যগত সেবা পাওয়ারও একটি পদ্ধতি গড়েছেন এই প্রযুক্তিবিদ। এমন বহু তথ্য-প্রযুক্তিগত পদ্ধতি তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে। এ সবই প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে এবং মহলে।

বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি বিজনেস স্কুলের ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন। দেশটির শীর্ষস্থানীয় আইটি গবেষক বলতেই তাঁর নামটি চলে আসে। এর আগে ইউনিভার্সিটি অব দ্য সানশাইন কোস্টে অধ্যাপনা শুরু করেন ২০০৩ সালে। এ ছাড়া গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি এবং জেমস কুক ইউনিভার্সিটিতেও শিক্ষকতা করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেই অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান। অবশ্য পরে এ বিভাগের নাম পরিবর্তন হয়েছে, যুক্ত হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং শব্দটি। বিজনেস ডিসিশান সাপোর্ট সিস্টেসম এর ওপর পিএইচডি লাভ করেন গ্রিফিথ থেকে। ক্রমেই তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। এতে যোগ হয়েছে বিজনেস ইন্টেলিজেন্স এবং বিগ ডেটা অ্যানালাইসিসের মতো জটিলতর বিষয়গুলো। ২০০০ সালে দেশ ছাড়ার পর আর থেমে থাকেননি। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন তথ্য-প্রযুক্তি জগতে।

তিনি লিখেছেন গবেষণা বই, জার্নাল আর্টিক্যাল, বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ের অধ্যায় এবং বড়সড় কনফারেন্স আর্টিক্যাল। ড. শাহ মিয়ার ১২০টির মতো গবেষণা সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা দুনিয়াজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছে। তাঁর লেখনি বিশ্বের নামকরা সব প্রকাশনায় স্থান করে নিয়েছে। এর মধ্যে আছে জার্নাল অব দ্য অ্যাসোসিয়েশন ফর ইনফরমেশন সিস্টেমস, ইনফরমেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, নলেজ-বেজড সিস্টেমস কিংবা ইনফরমেশন টেকনলজি অ্যান্ড পিপল’র মতো প্রকাশনায়। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বিজনেস ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ, দ্য জার্নাল অব এডুকেশন অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনলজিস এবং অস্ট্রেলিয়ান জার্নাল অব ইনফরমেশন সিস্টেমস এর সম্পাদকীয় বোর্ডেও স্থান করে নিয়েছেন তিনি। অতি সম্প্রতি আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বিজনেস ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ (আইজেবিআইআর) এর এডিটর-ইন-চিফ পদে আসীন হয়েছেন। এটা তাঁর জন্যে একটা বড় অর্জন বলেই মনে করছেন।

কর্মজীবনে পুরস্কারের ঝাঁপি বেশ স্ফীত তাঁর। বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট পার্টিসিপেন্ট অ্যাওয়ার্ড এবং আউটস্ট্যান্ডিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্মানসূচক পদে আছেন। ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যাকাডেমিক বোর্ডের সদস্য তিনি। ইউনিভার্সিটি আব ফিজি’র ইনফরমেশন টেকনলজি বিভাগের অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর। বাংলাদেশের বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েরও অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর তিনি। আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট আর্থ-সামাজিক ইস্যু নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অ্যাসোসিয়েশন অব ইনফরমেশন সিস্টেমস (এআইএস), অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি (এসিএস) এবং আইইইই এর সম্মানিত সদস্য তিনি।

ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থীদের একজন সুপারভাইজর ড. শাহ মিয়া। গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। তাঁর আগ্রহের বিষয়গুলোর মধ্যে আছে ডিসিশান সাপোর্ট অ্যাপ্লিকেশন্স ডিজাইন ফর বিজনেস; সোশিও-টেকনিক্যাল ডিজাইন থিওরি; বিগ ডেটা, লোকেশনাল অ্যানালিটিক্স/ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ডিসিশান সাপোর্ট; ই-সার্ভিসেস অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন্স ফর কনজ্যুমার্স, হেলথকেয়ার, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ওয়েল-বিয়িং ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। তাঁর অধীনে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পিএইচডি করছেন অনেকে। জানালেন, এদের মধ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও মেলে।

বাংলাদেশ থেকে যারা যান, তাদের আপনি কী ধরনের পরামর্শ দেন? দেশের জন্যে করণীয় বিষয়ে তাদের পরামর্শ প্রদানে বিশেষ চিন্তা থাকে আপনার?
‘অবশ্যই থাকে। তারা যেসব বিষয়ে থিসিস করতে যান, বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে তার বাস্তবিক প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। দেশে ফিরে যেন তারা কেবল ক্যারিয়ার নয়, মাটির জন্যেও কিছু করতে পারেন তার জন্যে উৎসাহ দেয়া আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে’।

দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার জীবন কাটছে। তবে দিনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটে পেশাগত গবেষণায়। এখন দেশের জন্যে কিছু করতে চান। যেকোনো দেশে যেকোনো প্রতিষ্ঠানে গেলে নিজের পরিচয় দেয়ার আগে বাংলাদেশের কথা তুলে ধরেন।

দেশে খুব বেশি সময় থাকতে পারেননি। পরিজনদের নিয়ে বাবার পাশে সময় কেটেছে। এখান থেকে সোজা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা তাঁর। সেখানে দেশটির এক সরকারি এজেন্সি ‘মারা’র আয়োজনে বক্তব্য দেবেন। মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষকে বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা স্থাপনে সহযোগিতা দেয় এই এজেন্সি। ওখানে আমাদের দেশের ড. শাহ মিয়ার মতো অনেক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও সহায়তা দরকার। ঠিক যেমনটা আমাদেরও দরকার।