‘না বলা শিখুন’ এবং…

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

এ অধিবাসের সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পকার তাঁর এক নাটকে এক বিশিষ্ট চরিত্রের মুখ দিয়ে একটি কথা বলিয়েছিলেন। আড়াই দশক আগের হলেও তা হয়তো অনেক দর্শকই ভুলে যাননি। কথাটি ছিল ‘পারলেন না তো না বলতে?’ ‘না’ বলা শিখুন। এই বাক্যটি তাৎপর্যপূর্ণ নানা দিক থেকে। তা হলো, সমাজের একশ্রেণির মানুষের অন্যায্য অভিপ্রায়, তা থেকে আত্মরক্ষার কৌশল এবং এই লেখকের ব্যক্তিমানস চেনার চেষ্টা।

তা প্রাসঙ্গিক হবে না যদি এ সঙ্গেই যেকোনো রাজনৈতিক আমলে যেকোনো সংবাদপত্রে একটি নির্দিষ্ট সংবাদ পরিবেশনার শিরোনাম মনে করে দেখি। ওটি হলো, কোনো মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা সমাজের যেকোনো প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার খবর ছাপানোর সময় সাংবাদিকেরা একটি স্ট্যান্ডার্ড বাক্য ব্যবহার করে থাকেন। ‘মন্ত্রী মহোদয় ধৈর্যসহকারে তাঁদের বক্তব্য শ্রবণ করেন।’ এ থেকে বোঝা যায় বক্তব্য ছিল জোরালো, দীর্ঘ, দাবি পেশমূলক অনেকাংশে অযৌক্তিক, অন্যায্য এবং বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতি উত্পাদক। নইলে মহোদয়কে ধৈর্য ধরে বক্তব্য শুনতে হবে কেন?

তিনি জনপ্রতিনিধি। কূটনীতি তাঁর নিত্য অনুষঙ্গ। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সব দাবি বা বক্তব্য বাস্তবায়ন না করতে পারলেও এবং সেগুলো যুক্তিসংগত না হলেও তিনি মুখের ওপর না বলে নির্বাচকদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারেন না। তাই তাঁর সাক্ষাৎ ও বক্তব্য শ্রবণ অব্যাহত থাকে। কিন্তু এই জনপ্রিয় লেখক তাঁর পাঠকদের সরাসরি শিখিয়েছেন ‘না’ বলতে। নিজের সম্পদ, সময়, খ্যাতি ও সামগ্রিক স্বার্থ অটুট ও অব্যাহত রাখতে এর প্রয়োজন ছিল।

এই লেখক কোনো বিশিষ্ট বা সাধারণ উদীয়মান লেখকের কোনো সাহিত্যকর্মের প্রশংসা বা পর্যালোচনা প্রায় করেননি। লেখক উল্লেখযোগ্য সম্পদ অর্জন করলেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা নবীন লেখক প্রকল্পও তিনি স্থাপন করেননি। অন্যের সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করলে সেই লেখকের খ্যাতির মাত্রা আরম্ভ হতে পারত। পাঠকের চোখে এটা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয় যে কোনো নবীন লেখকের লেখার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠিত ও বিশিষ্ট লেখকেরা কেউ কিছু বলছেন কি না। খ্যাতির যাত্রার সঙ্গে অর্থাগমও বেড়ে যেত। নবীন লেখক প্রশিক্ষণও একই ফল দিত। ফলে তাঁর নিজের ওই দুটি ক্ষেত্র কিছুটা হলেও কম মনোযোগ পাওয়া আরম্ভ হতো বলে তাঁর আশঙ্কা ছিল। তেমনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে তাঁর সম্পদ বেশ খানিকটা হ্রাস পেত। কাজেই ‘না বলা শিখুন’ যে তাঁর না বলে উপায় ছিল না।

আমাদের মননে, দর্শনে, বিশ্বাসে ও নীতিতে যা সুপ্ত হয়ে থাকে, মুখ ফুটে তা একদিন প্রকাশ পাবেই। যেমন যিনি পান করা পছন্দ করেন তিনি কোথাও গেলে তা খুঁজবেন। পাঠাভ্যাস যাঁর মজ্জাগত, তিনি খোঁজেন বই। রাজনীতি বা খাদ্যে যাঁর প্রবণতা, তিনিও কোনো সমাবেশে এই বিষয়ের আলোচনা তুলবেনই। তেমনি আত্মপরতা যাঁর প্রধান ঝোঁক, তা–ও বের হয়ে আসবেই। কোনো সন্দেহ নেই যে এই লেখকের অন্তত পাঁচটি সাহিত্যকর্ম মানোত্তীর্ণ ও রসোত্তীর্ণ তো অবশ্যই হয়েছে। এগুলো মহাকালোত্তীর্ণও হবে। সেটি একদিক। কিন্তু জীবনের আরও পরিণত সত্তার এই ‘না বলা’ দর্শনের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন এই লেখক অবিস্মরণীয়ভাবে।

২.
কিন্তু বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ শিল্পী এই সব ক্ষেত্রে কী করেছেন এবং বলেছেন, তা দেখা যাক। তিনি আরম্ভ করলেন ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ বলে। এটি এক বড় ‘হ্যাঁ’ বলা শিখুন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বেশ পর তাঁর তো নভোচারী হয়ে যাওয়ার কথা। তার বদলে তিনি কাছে টেনেছেন এবং প্রশংসা করেছেন পূর্ব বাংলার জসীমউদ্‌দীনকে, সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখাকেও মোটেই অবহেলা করেননি। আর নজরুল? তা বলাই বাহুল্য। যে সম্মান এবং পরামর্শ তিনি তাঁকে দিয়েছেন, তা বিরল নয়, তার কোনো উদাহরণ নেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। শরত্চন্দ্রকে আলোর পাদপীঠে তিনিই এনেছিলেন। মেজদিদি উপন্যাস পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে এক কেশতেল কোম্পানিকে বললেন এই নবীন প্রতিভাকে একখানি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। এই স্বীকৃতি তাঁকে জনমনোযোগের মধ্যে আনা শুরু করল।

পাবনায় বাঘাবাড়ী ঘাটের যে শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে আমরা এখনো খাঁটি গরুর দুধ পাই, সেই স্থাপনার সমুদয় জমি তাঁরই দান করা। আর ‘শান্তিনিকেতন’-এ তাঁর সংগীত শিক্ষা গ্রহণকারীদের সংখ্যা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য হতে পারে। এই কবিশ্রেষ্ঠ ওই প্রাঙ্গণের ব্যাপক অর্থনৈতিক ব্যবহার করতে পারতেন। সাহিত্য তাঁর প্রাণ হলেও রাজনীতির ক্ষেত্রেও মাত্র একটি বিবৃতি দিয়ে তিনি তাঁর বিশ্বমাপের উদারতা এবং ইতিবাচকতার অকাট্য প্রমাণ রেখে গেছেন। ১৯৩৮ সালে ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ ভারতের মুসলমানরা একটি স্বাধীন স্বদেশভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম করিতেছে, ইহার জন্য তাহাদের চাইতে আমাদের দোষই বেশি। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসাবে আমরা কি কখনো তাহাদিগকে কাছে টানিয়া বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছি?’

তিনি ধূর্ত হলে বলতে পারতেন যে রাজনীতি বা কংগ্রেস আমার পেশা নয়, অধীত বিষয় নয়। কাজেই এ বিষয়ে আমি কেন কিছু বলব? তার বদলে সম্প্রদায়ের স্বার্থের বিরুদ্ধে বিপন্ন এক ভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের পক্ষে তিনি এই বিবৃতি দেন। যাঁর চোখে পড়েছে ‘বিশ্ব ভরা প্রাণ, আকাশ ভরা সূর্য তারা’র মতো অপরিমেয় বিশাল সব বিষয়, তিনি তো এমনি মহৎই হবেন। কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে নয় বরং সবারটা রক্ষা করে আমরা মহৎ হতে পারব।
তার জন্য ভালো মানুষকে ভালোবেসে এবং খারাপদের বিশ্বাস করে কাছে টেনে সংশোধন করার কাজে আমাদের ব্রতী হতে হবে। নইলে বিশ্বকবির কাছ থেকে শুধু জাতীয় সংগীত নিলে হবে?

এটা ঠিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ও বাংলা ভাগের প্রস্তাবে কবিগুরু সম্মত হননি। কিন্তু ১৯০৫ আর ১৯৩৮-এ তাঁর বয়স এক ছিল না। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘কৃতকর্মের ফল বোঝা অল্প বয়সের কর্ম নহে।’ মুসলমানদের স্বার্থে কথা বলে তাঁর সব ‘পাপ’ স্খালন হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার সুখের সন্ধান করা তো দূরের কথা মাত্র। ৪১ বছর বয়স থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে তিনি স্ত্রীবিহীন জীবনযাপন করেও দেখিয়েছেন—মৃত স্ত্রীর পবিত্র স্মৃতির মধ্যে আর কারও স্থান হওয়া অনুচিত।