নার্সিং কোর্সে ভর্তিতে জালিয়াতি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ১৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ উঠেছে। এদের কেউ ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেনি। আবার কেউ পরীক্ষায় অংশও নেয়নি। এমনকি অপেক্ষমাণ তালিকায়ও তাদের নাম ছিল না।

গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষার পর এরা ভর্তি হয়েছিল। এসব প্রার্থীর তালিকা অধিদফতর থেকে নিবন্ধনের জন্য নার্সিং কাউন্সিলে পাঠানো হলে কাগজপত্রে অসঙ্গতির বিষয়টি ধরা পড়ে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবগত করা হলে ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা ও নার্সিং বিভাগ, নার্সিং অধিদফতর ও নার্সিং কাউন্সিলের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ভর্তিতে অনিয়মের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে বিভিন্ন সময় সরকারি নার্সিং কলেজ ও নার্সিং ইন্সটিটিউটে পোস্ট বেসিক বিএসসি নার্সিং, বেসিক বিএসসি নার্সিং কোর্সে ভর্তিতেও এমন অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যাবে। 

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘এমনটি হওয়ার কথা নয়। তারপরও যদি এ ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে যে ১৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে তাদের মধ্যে দু’জন নোয়াখালী, চারজন যশোর ও তিনজন কুমিল্লা নার্সিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। এছাড়া একজন করে মুন্সীগঞ্জ, পিরোজপুর, কিশোরগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, নওগাঁ, দিনাজপুর, মানিকগঞ্জ, পটুয়াখালী ও ঢাকা কমিউনিটি নার্সিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। এসব শিক্ষার্থী গত পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে ক্লাস করছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নোয়াখালী নার্সিং ইন্সটিটিউটে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সে (২০১৮-১৯ সেশন) ভর্তি হয়েছেন মোছা. মুনিয়া পারভীন, পিতা মো. আবদুল মান্নান। ভর্তি পরীক্ষায় (রোল নম্বর- ৩৩৪২৭১) তিনি পাস করেননি। পরীক্ষার প্রবেশপত্রে তার নাম মোছা. মুনিয়া পারভীন। ফলাফলে নাম আছে মোছা. তহুরা খাতুন। একই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন বেবি আক্তার, পিতা বাবুল হোসেন, রোল-৭৩৩২৬৮। তার পরীক্ষার প্রবেশপত্রের তথ্যের সঙ্গে ফরমের মিল নেই। প্রবেশপত্রে নাম বেবি আক্তার হলেও ফলাফলে নাম রয়েছে রেশমা আক্তার। যশোর নার্সিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছেন মোছা. মনিরা খাতুন, পিতা মো. জয়নাল মোল্যা, রোল- ৪৩২১৪৩, ভর্তি পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বর ২৫।

রেজাল্ট সিটে, অপেক্ষমাণ ফলাফলে এমনকি প্রজ্ঞাপনেও তার নাম উল্লেখ না থাকলেও তিনি ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। একই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন আফসানা মিমি লিমা, পিতা ছানোয়ার হোসেন, রোল-৪৩০১০৫। ভর্তি পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বর ৩৮। রেজাল্ট সিট, অপেক্ষমাণ ফলাফলে এবং প্রজ্ঞাপনেও নাম উল্লেখ না থাকলেও তিনি ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। একইভাবে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন মোছা. ফাতেমা খাতুন, পিতা মো. মনিরুজ্জামান, রোল-৪৩২৩০৫। শারমীন আক্তার, পিতা মুনসুর আলী, রোল-৪১০২১৮। কুমিল্লা নার্সিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছেন মো. লিমন মিয়া, পিতা গোলাপ মিয়া, রোল-৭৩৪৫৭০।

ফলাফলে নাম না থাকলেও অপেক্ষমাণ তালিকায় নাম থাকায় যারা বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে অবৈধভাবে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে মুন্সীগঞ্জের রোকসানা আক্তার, রোল-৭১১২০০, পিরোজপুরের আঁখি বড়াল, রোল- ১১১১০৭, কিশোরগঞ্জের মোছা. শ্রাবণী চৌধুরী, রোল-৭১০৮৫০, রাঙ্গামাটির দিপা রানী রায়, রোল-৭১০৬১৮, কুমিল্লার নাসরীন খাতুন, রোল-৩১০৯৫৭, নওগাঁর মোছা. আন্না আক্তার, রোল-৮১০২৬৮, দিনাজপুরের উম্মে আয়মন, রোল-৬১০২৩৬, মানিকগঞ্জের মিতু আক্তার, রোল-৮১০০৯৪ এবং পটুয়াখালীর সাহেদা আক্তার, রোল-৬১০৭২৩। এছাড়া ঢাকা কমিউনিটি নার্সিং কলেজে ভর্তি হয়েছেন মো. রিয়াদ হোসেন, রোল-১৩২২২৮। প্রবেশপত্রের সঙ্গে এই শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন ফরমের ছবির মিল পাওয়া যায়নি। ভর্তিতে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম যুগান্তরকে বলেন, দেশের বিভিন্ন নার্সিং ইন্সটিটিউটে মোট ১৭ জন শিক্ষার্থীর ভর্তিতে অনিয়মের তথ্য আমরা পেয়েছি।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় (চিকিৎসা অনুবিভাগ) ও নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের মহাপরিচালককে অবহিত করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অধিদফতর প্রণীত জাতীয় মেধা তালিকা অনুসরণ করে বিভিন্ন নার্সিং ইন্সটিটিউটে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য কাউন্সিলে আবেদন করতে হয়।

আবেদনপত্রের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সব তথ্য পাঠাতে হয়। কিন্তু এবার অধিদফতর থেকে পাঠানো নামের তালিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কলেজের ভর্তি তালিকা মিলিয়ে তবেই শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন প্রদান করা হয়।

এক্ষেত্রে গত ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রণীত মেধাতালিকার সঙ্গে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাগজপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে ১৭ শিক্ষার্থীর ভর্তির বিষয়ে অনিয়ম ধরা পড়লে তারা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান। পরবর্তী সিদ্ধান্ত তারাই দেবেন।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণের মাধ্যমে ওই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়েছে। অধিদফতরের একটি চক্র অবৈধ এই ভর্তি বাণিজ্য সম্পন্ন করেছে। এ অপকর্মে অধিদফতরের পদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত রয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতরের মহাপরিচালক তন্দ্রা শিকদারকে একাধিকবার ফোন করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা) ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি অবহিত। এ ব্যাপারে যুগ্মসচিবের (নির্মাণ ও মেরামত অধিশাখা) নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত করছেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাতিল করা হবে। পাশাপাশি অধিদফতরের কেউ যদি জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রসঙ্গত, শিক্ষাক্ষেত্রে ও পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে ২০১১ সালে নার্সিং পরিদফতরকে নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরে রূপান্তর করা হয়। নার্সদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নার্সদের তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা দেন। এ প্ররিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরের অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে ১০০ নম্বরের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্রে বিএসসি ইন নার্সিং, ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সে এ ভর্তি পরীক্ষা হয়।

৪৩টি সরকারি ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি ইন্সটিটিউশনে দুই হাজার ৫৮০টি, ৩৮টি ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি ইন্সটিটিউশনে ৯৭৫টি এবং চার বছর মেয়াদি ১৮টি সরকারি বিএসসি ইন নার্সিং কলেজের আসন সংখ্যা এক হাজার ৪৩৫টি। এসব আসনের বিপরীতে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন।