নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে অনলাইন মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর শিক্ষার্থীদের সাথে ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও তরুণ সমাজের ভাবনা’-শীর্ষক অনলাইন মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় অনলাইন মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম; ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডীন এবং যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ বিষয়ক অভিযোগ কমিটির চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. ফারহানা হেলাল মেহতাব, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর এ‌্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর ও আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জিনাত আরা শিপা এবং মতবিনিময় সভায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ।

সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম স্বাগত বক্তব্যে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ এর অভিঘাতসমূহ যখন মানুষ মোকাবেলা করছে তখন নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি সকলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কেবল পারিবারিক সহিংসতাই নয় ধর্ষণসহ নানা ধরণের সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ৫০ বছর ধরে রাষ্ট্রে নারীর মানবাধিকার ও নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে যেসকল কাজ করে চলেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করা। এই সহিংসতা দূর করার জন্য বৃদ্ধির জন্য তিনি নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্ষমতার কাঠামোয় নারী ও পুরুষের প্রতি যে ভ্রান্তধারণাসমূহ রয়েছে সেগুলো দূর করে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে কাজ করতে তরুণ সমাজকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডীন এবং যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ বিষয়ক অভিযোগ কমিটির চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. ফারহানা হেলাল মেহতাব বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বহুদিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে কিন্তু এতে সহিংসতা কমেছে সেটি দেখা যায় না। আসলে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে, দেখার মাধ্যমে শেখানোর মাধ্যমে একজন পুরুষ অপরাধী হয়ে বেড়ে উঠছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রয় ব্যবস্থা থেকে শিশুর দেখা ও শোনার জায়গা কলুষতা মুক্ত করতে হবে।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সংগঠন যে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে তার ভাগিদার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের সম্মুখভাগে থাকার আহ্বান জানান।

স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর এ‌্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর ও আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জিনাত আরা শিপা বলেন নারীর অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে আইন থাকার পরও সহিংসতা বাড়ছে ঘটনার দ্রুত দৃশ্যমান বিচার না হওয়ায়। এর জন্য পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুললে অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। পাশাপাশি নারী নির্যাতনের ৪টি দিক রয়েছে যেমন: শারীরিক, মানসিক, আর্থিক এবং সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার এসব বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করতে তিনি সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানান।তিনি নারীর প্রতি সহিংসতার সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কর্মীদের আরও জেন্ডার সংবেদশীল হওয়ার আহ্বান জানান।

শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তরে সংগঠনের লিগ্যাল এ‌্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক অ্যাড. মাকসুদা আক্তার লাইলী বলেন তরুণদের একদল সহিংসতা প্রতিরোধে আন্দোলন করছে আরেকদল সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নানা আইন থাকলেও সাক্ষীর সুরক্ষায় কোনো আইন নেই- এটির দাবি বর্তমানে আসছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে, সামাজিক রীতিনীতির কারণে নারী-পুরষের মধ্যে যে বৈষম্য আছে তা দূর করতে হলে অভিন্ন্ পারিবারিক আইন প্রণয়ন দরকার, যার দাবি মহিলা পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। এছাড়াও রাষ্ট্রকাঠামোয় বিদ্যমান বৈষম্য দূর না হলে কাঙ্খিত পরিবর্তন আসবে না। এছাড়াও বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি বড় কারণ। সহিংসতার ঘটনায় মাত্র ৩% মামলায় শাস্তি হয় যা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীরা ও নির্যাতনের শিকার। এমতাবস্থায় যদি তরুণরা বিচারের দাবিতে সমান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসে তবে এই অসমতা দূর হবে, নারী আন্দোলনের সমর্থক তৈরি হবে, এবং প্রত্যেকে তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সভায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী- মো: মাহবুবুল আলম খান, সৈয়দা বাতুল, গীতা বেদী হালদার, তামজিদ ইসলাম, নাইমুর মোর্শেদ নীরব, আব্দুল হারিম পিয়াস ও স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর শিক্ষার্থী মো: সিফাত হোসোইন, রিফাত জামান রাফি, আনিকা রহমান লিসা, আহসান ইসলাম, মোহাম্মদ রাশেদ খান, এ্যানি ধর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি চলমান সহিংসতা রোধে শিক্ষার্থীদের দেয়া মতামতগুলো অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। সামাজিক রীতিনীতি , পারিবারিক শিক্ষা মানুষকে অপরাধী হিসেবে তৈরি করে। অবস্থার প্রতিকারের জন্য শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান, সমাজ সংস্কারকরা এর পেছনে দায়ী কারণগুলো চিহ্নিত করবের এবং বিচারকরা অপরাধ ও অপরাধীর বিচার করবেন। সংবিধানে সকলকে সমানাধিকার দেয়া হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রচলিত যে আইনগুলো রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সামাজিক কাঠামোগত ধারণার পূণ: নির্মাণে কাজ করতে হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের মাধ্যমে ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে, অপরাধীর বয়কট করতে হলে সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে, নারীদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার দিতে হবে; তাদের আত্মমর্যাদা ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে হবে, জেন্ডার বান্ধব সমাজ গড়তে এগিয়ে আসতে হবে।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড সম্পাদক সাহানা কবির, লিগ্যাল এইড উপপরিষদের আইনজীবীবৃন্দ, আইটি বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীসহ সভায় মোট ৭৮ জন উপস্থিত ছিলেন। সভার সঞ্চালনায় ছিলেন সংগঠনের আইনজীবি অ্যাড. দীপ্তি সিকদার।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ