নারীরা শহরে কতটা নিরাপদ বোধ করেন?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সাজেদা আক্তার ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। বলছিলেন তিনি সবচাইতে বেশি নিরাপত্তা-হীনতায় ভোগেন রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে।

 

“মেয়েদের আলাদা কিছু সমস্যা আছে। যেমন মনে করেন বাসে গায়ের সাথে ঘেঁষে দাঁড়ানো। বাসে উঠতে গেলে হেলপার খারাপ ব্যবহার করে। চলতে পথে নানা কথা বলে। এরকম অনেক ঘটনা ঘটে। নিজেই সাবধান হয়ে চলি।”

 

সাজেদা বলছেন তিনি সাধারণত মুখ বুজেই নিজের পথে চলে যান।

 

“রাস্তাঘাটে কি প্রতিবাদ করবো? লোকজন বলবে মহিলাটাই খারাপ। এজন্য কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে যাই”

 

ঢাকা শহরে বেশ কটি এলাকায় নারীদের সাথে কথা বলে জানা গেলো শহরে চলাচলেই সবচেয়ে নীরাপত্তাহীনতায় ভোগেন নারীরা।

 

রাস্তায় আর গন পরিবহনে যৌন হয়রানি এক্ষেত্রে বেশ বড় করে এসেছে সাম্প্রতিক জরীপে।

সাজেদা আক্তার।

একশন এইড বাংলাদেশ সাম্প্রতিক এক জরীপে বলছে, ৮৭ শতাংশ নারী বাস টার্মিনাল বা ট্রেন স্টেশনের মতো যায়গায় হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

রাস্তায় আশি শতাংশ আর স্কুল কলেজের বাইরে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী।

গত কয়েক বছরে দেশে পিছু নেয়া নেয়া পুরুষের হাতে এমনকি খুন হয়েছেন স্কুল পড়ুয়া কয়েকজন মেয়ে।

পরিবহনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কর্মজীবী নারী।

কিন্তু উন্নয়ন কর্মীরা বলছেন বাংলাদেশে নারীর নিরাপত্তা-হীনতার সবচেয়ে বড় উৎস নিজের পরিবার।

রুপালী বেগম ঢাকার একজন গৃহকর্মী। তিনি বলছেন, “স্বামী খুব মারধোর করতো। বাসাবাড়িতে কাজ করে যে কটা টাকা পাই তা না দিলে মারত”

আইন ও সালিশ কেন্দ্র সংস্থাটির কর্মকর্তা নীনা গোস্বামী

ব্যুরো অফ ষ্ট্যাটিসটিকসের এক জরীপে দেখা গেছে বাংলাদেশে ৭২ শতাংশ নারী পারিবারেই স্বামীর নির্যাতন সহ নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার হয়ে নীরাপত্তাহীন জীবন যাপন করেন।

রয়েছে পরিবারেই নিকটাত্মীয়র কাছে যৌন নির্যাতনের ঘটনা।

কিন্তু মোটে দুই শতাংশ নারী সেনিয়ে আইনের দ্বারস্থ হন।

এ ধরনের নারীদের আইনি সহায়তা দেয় আইন ও সালিশ কেন্দ্র।

সংস্থাটির কর্মকর্তা নীনা গোস্বামী বলছেন কেন নারীরা অভিযোগ করেন না।

তিনি বলছেন, “নিরাপত্তার ইস্যু প্রতিদিন নারীরা ফেস করছে। কিন্তু তা স্বত্বেও তারা কিন্তু অনেক কিছু গোপন করে যায়। কারণ তাদের ভিতরে কিছু আশংকা কাজ করে যে যদি কিছু বলে তাহলে স্বামী তাকে ছেড়ে দেবে বা বাচ্চার কাস্টডি পাবে না। তাই তারা নির্যাতনের কথা বেশিরভাগ সময় চেপে যায়”

তার মতে নারীদের নিরাপত্তার সংস্কৃতিটাই বাংলাদেশে বিরল।

ট্রেন স্টেশনে এক নারী।

তিনি বলছেন, “সবকিছুই নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। পরিবারে, কর্মস্থলে, চলার পথে বা যানবাহনে তারা কতটুকু নিরাপদ তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। নারীদের নিরাপত্তার সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি বলেই তারা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার”

এমন নিরাপত্তা হীনতা থেকে চাকরি ছেড়েছেন পুরাণ ঢাকার সাবরিনা কাজি।

“আমি যেখানে কাজ করতাম সেখানে প্রায়ই শুধু মেয়েদের সন্ধ্যার পরে থাকতে বলা হতো। বেছে কয়েকজনকে। তারপর যেসব ভাষা ব্যবহার করা হতো তা অফিসে মেয়েদের সামনে ব্যবহার করা উচিত না। তারপর ধরুন কারো কারো গায়ে হাত দেয়া হতো। আমি যতই প্রগতিশীল হই না কেন এটা আমি কখনোই মেনে নেবো না”

কিন্তু তারপরও পরিবর্তন দেখছেন আজকের দিনের অনেক নারী।

ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী মৌরি নাজনীন বলছেন তিনি আর আগের মতো মাথানিচু করে পথ হাঁটেন না।

তিনি বলছেন, “আমাদের বাবা মা এক সময় শিখিয়েছে রাস্তাঘাটে কেউ কিছু বললে কিছু না বলে চলে যাবা তাহলে এটা আর আগে বাড়বে না। এরকম করার কারণেই কিন্তু বিষয়টি এ পর্যন্ত গড়িয়েছে। এখন যে পরিবর্তনটা হয়েছে তা হলো কোন প্রতিবাদ করলে দু একজন বলে ছেড়ে দেন। কিন্তু আরো দুজন তখন আমার পাশে এসে দাড়ায়। তাতে প্রতিবাদের সাহসটা তৈরি হয়”

মৌরি নাজনীন

তার মতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম শক্তিশালী হওয়ায় আজকাল প্রতিবাদ করার প্রবণতা বাড়ছে।

“যেমন ধরুন ফেসবুকে অনেক ঘটনা শেয়ার হচ্ছে। অনেক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। সেখানে এরকম ঘটনা অনেকে শেয়ার করে। সেখানে আমরা তখন বুদ্ধি পাই কি ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে সে নিয়ে অথবা আমার সাথে এমন হলে কি করা যায় সেটা বুঝতে পারি। এই পরিবর্তনটা হয়েছে”

ঘরে, বাইরে, কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তার সংস্কৃতির অভাব হলেও সমাজের নানা স্তরে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ।

আর তাই সাজেদার মতো অনেকেই বলতে পারছেন তিনি সাহস হারাচ্ছেন না।

তিনি বলছেন, “যুদ্ধ করেই জীবনটা চালাতে হবে। মনের মধ্যে সাহস না থাকলে কি আর পেটে ভাতের যোগান হবে?”

সূত্র: বিবিসি