নারীদের হিসাববহির্ভূত কাজ জিডিপির ৮৭ শতাংশের সমান

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার নারী। বর্তমানে নারী যে কাজ করে, তার মাত্র চার ভাগের এক ভাগ জাতীয় আয়ে যোগ হয়। একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২ দশমিক ১টি কাজ করে, যা জাতীয় আয়ে যোগ হয় না। এসব কাজের বার্ষিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৮৭ দশমিক ১ শতাংশের সমান। চলতি মূল্যে তা ১১ লাখ কোটি টাকারও বেশি (২০১৪ সালকে ভিত্তি ধরে)। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় এ তথ্য উঠেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই নারী। তাই তাদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ কারণে নারীর অবদানও সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। পাশাপাশি অর্থনীতিতে অবদান বাড়ানোর জন্য কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন  বলেন, নারী ঘরে বসে যে কাজ করে, তার অর্থমূল্য নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর হিসাব করা হয় না। সরকারি হিসাবেও জিডিপিতে নারীর অবদান মাত্র ৩০ শতাংশ। অর্থনীতিতে নারীর অবদান মূল্যায়নে জাতীয় আয়ের হিসাব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে জিডিপিতে নারীর অবৈতনিক কাজের মূল্য অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এ মূল্যায়নের পদ্ধতির জন্য সরকারকে একটি কমিটি গঠন করতে হবে।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে নীতিমালা জরুরি। তার মতে, আমাদের দেশে একক পরিবার গড়ে উঠছে। এজন্য কর্মজীবী নারীদের জন্য বাচ্চা রাখতে ডে-কেয়ারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে হবে। এছাড়া গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জানতে চাইলে সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক সালমা নাসরীন এনডিসি শনিবার যুগান্তরকে বলেন, প্রত্যেক নারীর প্রতিটি কাজের (ঘরে ও বাইরে) সমান মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি লাভের মধ্যেই নারী দিবসের সার্থকতা নিহিত।

যেসব পণ্য বা সেবা বাজারে বিক্রি করে অর্থ পাওয়া যায়, শুধু সেগুলোই জিডিপির হিসাবের মধ্যে আসে। কিন্তু এর বাইরে অনেক ধরনের কাজ রয়েছে, যা থেকে সরাসরি অর্থ আসে না। ফলে এগুলো জিডিপির হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। সিপিডির গবেষণা অনুসারে, নারী তার দিনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় গৃহস্থালি কাজে ব্যয় করেন। যার সামাজিক স্বীকৃতি বা অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হয় না। তুলনামূলক হিসাবে পুরুষের তুলনায় নারীর তিনগুণ সময় জাতীয় আয়ে যোগ হয় না। একজন নারী হিসাবের বাইরে প্রতিদিন ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা কাজ করে।

সংখ্যার বিবেচনায় এ ধরনের কাজ ১২ দশমিক ১টি। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে- রান্না, কাপড় কাচা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার, শিশু ও বয়স্কদের যত্ন, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় সাহায্য, রান্নার জন্য জ্বালানি ও পানি সংগ্রহ ইত্যাদি। সিপিডির খানা জরিপ অনুসারে এসব কাজ জাতীয় আয়ে যোগ হলে তার বার্ষিক মূল্য জিডিপির ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে খানার বাইরে সাধারণ মূল্য পদ্ধতি অনুসারে যা জিডিপির ৮৭ দশমিক ২ শতাংশ।

অর্থাৎ এসব কাজ অন্য কেউ করতে বললে তার বিনিময়ে নারীরা কত পারিশ্রমিক নিতেন, সেই আলোকে হিসাব করলে (গ্রহণযোগ্য মূল্য পদ্ধতি) সেসবের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় জিডিপির ৮৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়- নারীর এসব কাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে জিডিপির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ ধরা হতো। নারীর ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর দুই জায়গাতেই এই ব্যবধান রয়েছে। তবে হিসাবের বাইরে পুরুষের মাত্র ২ দশমিক ৭টি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতিতে নারীর সব কাজের স্বীকৃতি নেই। তার মতে, দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ নারী। হিসাবের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে দেখা গেছে, জিডিপিতে তাদের অবদান মাত্র ৩০ শতাংশ। অথচ হিসাবের বাইরে থাকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন ও সেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে নারী সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় যে ব্যবহারিক মূল্য সৃষ্টি করে, তার পরিমাণ এই ৩০ শতাংশের থেকে অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, জাতীয় আয়ে অবদানের স্বীকৃতি দিতে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর মজুরিভিত্তিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা সবার আগে দূর করা জরুরি।

বাংলাদেশ উইমেন চেম্বারের সভাপতি সেলিমা আহমাদ বলেন, নারী গৃহে যেসব কাজ করছে, তার স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কারণ নারী ঘরে যে কাজ করছে, সেটি অন্য কাউকে দিয়ে করানো হলে তার মূল্য দেয়া লাগত। তিনি বলেন, সমাজে বা রাষ্ট্রে স্বীকৃতি না পেলে পরিবারেও সম্মান পায় না। তার মতে, কর্মক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। উদ্যোক্তা হিসেবেও এগিয়ে আসছেন তারা। এতে অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়ছে।

কিন্তু সব কাজ আর্থিক হিসাবে যোগ হয় না। ফলে হিসাব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। তিনি বলেন, সার্বিকভাবে নারীর এ অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে হলে সবার আগে নিরাপত্তা জরুরি। গণপরিবহন সব জায়গায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। তবে সরকার নানা ধরনের ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান তিনি। সেলিমা আহমেদ বলেন, সরকার নারীদের জন্য অনেক কিছু করেছে, তবে সামাজিক ভাবমূর্তি, গঠনমূলক কর্মকাণ্ড ও অনুকূল পরিবেশ জরুরি।