নাতিদের প্রতি মহানবীর স্নেহ-ভালোবাসা

রাসুল (সা.) ছিলেন মানবসভ্যতার আদর্শ। নববি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানবীয় গুণাবলিতে তিনি ছিলেন সবার অনুকরণীয়। সাধারণ মানুষের মতোই ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। স্ত্রী, সন্তান ও নাতিদের নিয়ে ছিল তাঁর পরিবার। তাই উম্মতের রাসুল হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী, বাবা, নানা ও পরিবারে সচেতন সদস্য। নানার ভূমিকা পালন করে নাতি-নাতনিদের সঙ্গেও সময় কাটিয়েছেন। তাদের আনন্দে তিনি আনন্দিত হয়েছেন। কেমন ছিল নাতিদের সঙ্গে কাটানো রাসুল (সা.)-এর সেই আনন্দঘন মুহূর্তগুলো! সে রৌদ্রকরোজ্জ্বল মুহূর্তগুলো, সে ব্যাপারে আলোকপাত করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।

রাসুল (সা.)-এর নাতি-নাতনির সংখ্যা : সিরাত গ্রন্থ থেকে রাসুল (সা.)-এর আটজন নাতি-নাতনির কথা জানা যায়। জয়নব (রা.) ও আবুল আসের ঘরে দুজন : আলী ও উমামা। রুকাইয়া ও উসমানের ঘরে একজন : আবদুল্লাহ। ফাতেমা (রা.) ও আলী (রা.)-এর ঘরে পাঁচজন : হাসান, হুসাইন, মুহসিন, জয়নব ও উম্মে কুলসুম। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/৩০৬)

হাসান-হুসাইনের নাম নির্বাচন : আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, হাসান ভূমিষ্ঠ হলে আমি তার নাম রাখলাম হারব (যুদ্ধ)। রাসুল (সা.) এসে বলেন, আমার নাতিকে দেখাও, তোমরা তার কী নাম রেখেছ? আমরা বললাম, হারব। তিনি বলেন, বরং তার নাম হাসান রাখো। পরে হুসাইন ভূমিষ্ঠ হলে আমি তার নাম রাখলাম হারব। রাসুল (সা.) এসে বলেন, আমার নাতিকে দেখাও, তোমরা তার কী নাম রেখেছ? আমরা বললাম, হারব। তিনি বলেন, বরং তার নাম হুসাইন। অতঃপর তৃতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আমি তার নামও রাখলাম হারব। অতঃপর রাসুল (সা.) এসে বলেন, আমার নাতিকে দেখাও, তোমরা তার কী নাম রেখেছে? আমরা বললাম, হারব। (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ৭৮০)

নাতিদের চুম্বন ও কোলে নেওয়া : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসুল (সা.) হাসান-হুসাইনকে কাঁধে নিয়ে বের হলেন (দুই কাঁধে দুজন ছিল)। তিনি একবার হাসানকে চুমা দেন আরেকবার হুসাইনকে, এভাবে করতে করতে আমাদের কাছে আসেন। তখন এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি এদের খুব ভালোবাসেন? তখন তিনি বলেন, ‘যে তাদের (হাসান-হুসাইন) ভালোবাসবে সে আমাকে ভালোবাসবে। আর যে তাদের রাগান্বিত করবে সে আমাকে রাগান্বিত করবে। (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ৯৯২৪)

রাসুল (সা.)-এর কাঁধে আরোহণ : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে এশার নামাজ পড়ছিলাম। রাসুল (সা.) সিজদা করলে হাসান – হুসাইন লাফ দিয়ে তাঁর পিঠে উঠত। রাসুল (সা.) সিজদা থেকে ওঠার সময় তাদের হাত দিয়ে নামিয়ে দিতেন। তিনি আবার সিজদা করলে তারাও আবার পিঠে উঠত। এভাবে তিনি নামাজ শেষ করেন। (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ৭৮৭৬)

আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা আমরা মসজিদে বসা ছিলাম। এমন সময় রাসুল (সা.) স্বীয় কন্যা জয়নবের মেয়ে উমামাহ বিনতে আবুল আসকে নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। তখন উমামা শিশু ছিল, রাসুলুল্লাহ তাকে কাঁধে নিয়ে নামাজ আদায় করেন। তিনি রুকু করার সময় তাকে নামিয়ে রাখতেন এবং দাঁড়ানোর সময় আবার কাঁধে উঠিয়ে নিতেন। এভাবে তিনি নামাজ আদায় শেষ করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৯১৮)

নাতিদের জন্য দোয়া : আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, দিনের এক প্রহরে আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে রওনা হলাম। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আমিও তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম না। অবশেষে বনু কাইনুকার বাজারে পৌঁছেন। অতঃপর তিনি ফিরে এসে ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে ঢুকেন। ফাতেমাকে বললেন, ‘এখানে কি শিশু আছে, এখানে কি শিশু আছে, অর্থাৎ হাসান।’ ফাতেমা (রা.) তাঁকে দেরি করাচ্ছেন। আমরা অনুমান করি যে তার মা তাকে সোনা-রুপা ছাড়া পুঁতির মালা পরাচ্ছেন—যা বাচ্চাদের পরানো হয়। কিন্তু অল্পক্ষণের ভেতরেই হাসান দৌড়ে চলে এলেন এবং রাসুল (সা.)-এর  গলা জড়িয়ে ধরলেন। সে সময় রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তাকে পছন্দ করি, তুমিও তাকে পছন্দ কোরো, আর পছন্দ কোরো তাদেরও যারা তাকে পছন্দ করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬১৫১)

ইয়ালা বিন মুররাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা তাঁরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে আহারের জন্য যান। তখন হুসায়ন (রা.) গলির মধ্যে খেলছিলেন। রাবি বলেন, রাসুল (সা.) মানুষের এগিয়ে এসে নিজের দুই হাত প্রসার করেন। ছেলেটি পালাতে শুরু করলে নবী (সা.) হাসতে হাসতে তাকে ধরে ফেলেন। এক হাত ছেলের চোয়ালের নিচে এবং আরেক হাত মাথার তালুতে রেখে তাকে চুমো দিলেন। অতঃপর বললেন,‌ `‌‌‌‌হুসাইন আমার অংশ এবং আমি হুসাইনের অংশ। যে ব্যক্তি হুসাইনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাআলা তাকে ভালোবাসেন। হুসাইন আমার নাতিদের একজন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৭৭৫)

নাতিদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর সম্পর্কটা ছিল ভালোবাসার অটুট বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছেন। তাদের কাঁধে তুলে  নিয়েছেন। কোলে বসিয়েছেন। তাদের আনন্দ দিয়েছেন। নিজে আনন্দিত হয়েছেন।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ