নরসুন্দরের মুখে বগুড়ায় মা-মেয়ে নির্যাতনের ভয়াল তথ্য

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: বগুড়ায় মা-মেয়েকে বর্বরোচিত নির্যাতনের অন্যতম হোতা নারী কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকির নব্য আওয়ামী লীগার হয়ে ওঠার ঘটনাও এখন বগুড়ায় আলোচনার অন্যতম ইসু। এ ছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানিতে উঠে আসছে নির্যাতনের আরো অনেক ভয়াল দৃশ্য। সেদিন নরসুন্দর (নাপিত) জীবন ইতস্তত করায় তাঁর হাত থেকে কাঁচি নিয়ে কাউন্সিল রুমকি নিজেই মা-মেয়ের চুল কেটে দিয়েছিল। মারধর ও ন্যাড়া করার অমানুষিক নির্যাতনের দৃশ্য রুমকি ১৩ বছরের মেয়েকে দিয়ে ভিডিও করায়। নির্যাতনে ধর্ষক তুফান সরকারের স্ত্রী ও শাশুড়িও অংশ নেয়।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুমকির পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাবা বিএনপি করেন। রুমকি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চানের ভাগ্নি। প্রায় এক বছর আগে সে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবেই কাউন্সিলর হয়। ক্ষমতার দাপট বাড়াতে মাত্র তিন মাস আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। বিএনপিতে ওয়ার্ড কমিটির নারী দলের সামান্য সদস্য ছিল, আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই বাগিয়ে নেয় ওয়ার্ড মহিলা লীগের যুগ্ম সম্পাদকের পদ।
বিচারের নামে এলাকাবাসীকে হয়রানির অভিযোগও তার বিরুদ্ধে কম নেই। কিন্তু ভয়ে আশপাশের মানুষ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

এদিকে গতকাল নরসুন্দর জীবন বগুড়ার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম শ্যামসুন্দর রায়ের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। একই আদালত প্রধান আসামি তুফান ও তার সহযোগী মুন্নাকে দুই দিনের এবং আশা ও তার মা রুমির এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। রিমান্ড শেষ হওয়ায় কাউন্সিলর রুমকি, তুফানের সহযোগী দীপু, জিতু, তুফানের শ্বশুর জামিলুর রহমান রুনুকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

ধর্ষণ ও নিপীড়ন মামলার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে গতকালও বিক্ষোভ-মানববন্ধন হয়েছে বগুড়ায়। দ্রুত আইনে বিচার ও ফাঁসির দাবিতে ঝাড়ু মিছিল করেছে জেলা জাতীয়তাবাদী মহিলা দল। মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ। গতকাল বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হচ্ছে। এখানে অনেক প্রমাণ ও আলামত আছে। সাক্ষী আছে। কোনো আসামি পার পাবে না। ’

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে নাপিত জীবন জানিয়েছেন, গত ২৮ জুলাই দুপুরে মুন্না তাঁকে ডেকে আনতে যায়। জীবন যাবেন না বলে জানিয়ে দেন। এরপর আতিক গিয়ে তাকে জোর করে নিয়ে যায় রুমকির বাসায়। ঘরে ঢুকে জীবন দেখেন তরুণী ও তার মাকে মারধর করা হচ্ছে।

রুমকি ও আশা তখন জীবনকে বলেন মা ও মেয়ের চুল কেটে ন্যাড়া করে দিতে। জীবন রাজি হননি। তখন তাঁর হাত থেকে কাঁচি কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর রুমকি, তার বোন আশা ও মা রুমি সেই কাঁচি দিয়ে ধর্ষিতা মেয়েটির চুল কাটে। মেয়েটির মায়ের চুল কাটে আতিক, দীপু, মুন্না ও শিমুল। এর পর জীবন দুজনের চুল ন্যাড়া করে দেন। ওই সময় মা ও মেয়ে নীরবে কাঁদছিল বলেও জানান জীবন।

নির্যাতনের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার এজাহারেও মেয়েটির মা বলেন, ‘৩টায় তার (রুমকি) ড্রইংরুমে আটকাইয়া রুমকি, আশা ও রুমী আমার মেয়ের চুল কাঁচি দিয়া কাটে এবং আতিক, দীপু, মুন্না, শিমুল আমার চুল কাঁচি দিয়া কাটিয়া দেয়। ’ ধর্ষিতা মেয়েটিও কালের কণ্ঠকে বলেছেন, চুল কাটার সময় তারা ভয়ে চিৎকারও করেনি। অনেকে তাদের এই করুণদশা দেখলেও প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছিল না। রুমকির মেয়ে চুল কাটার ভিডিও করেছে—এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এসপি আসাদুজ্জামান বলেন, ‘চুল কাটার দৃশ্য ধারণের বিষয়টি আমরা পাইনি। তবে কে বা কারা কিভাবে কাটল তা বিস্তারিত জেনেছি। সে অনুযায়ীই তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

কে এই রুমকি : পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর রুমকির বাবা জামিলুর রহমান রুনু চামড়ার ব্যবসায়ী এবং বিএনপির ওয়ার্ড স্তরের নেতা। বগুড়া পৌর নির্বাচনও রুমকি করে বিএনপির ব্যানারে। এই রুমকিই গত ৭ মার্চ বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করে।

জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান রনি জানান, রুমকি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চানের ভাগ্নি। তার আওয়ামী লীগে যোগদান এবং পরবর্তী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য তার জানা নেই। বগুড়া বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘রুমকি আমাদের দলেই ছিল। কাউন্সিলর হওয়ার পর আওয়ামী লীগে যায়। ’

পুলিশ সুপারের ভাষ্য : বগুড়ার এসপি গতকাল তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘটনার মূল আসামি তুফান সরকারসহ ১১ আসামিকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছি। শুধু একজন গ্রেপ্তার হয়নি। ভিকটিম ও তার মায়ের চিকিৎসা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করছি। ’ তুফানের বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ আছে কি না জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, এর আগে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা আছে। সব মামলায়ই জামিনে ছিল। নতুন দুটি এখন তদন্ত করছি। ’ মাদক ব্যবসাসহ চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তুফান ও তার ভাই মতিন সরকারের বিরুদ্ধে।

এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ আছে কি না, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কেউ অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। ’ হত্যা মামলার পরোয়ানা আছে বলেও অভিযোগ আছে—এমন প্রশ্নে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশের কাছে মতিনের কোনো মামলার পরোয়ানা নেই। আমি শুনেছি, গত ১৮ জুন হত্যা মামলায় পরোয়ানা ইস্যু হয়েছে। আমাদের কাছে আসেনি। আদালতের বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে পারব না। তবে পরোয়ানা পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা খোঁজ নেব। ’

আসামিদের পেছনে আর কোনো প্রভাবশালীর হাত আছে কি না জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘প্রমাণ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। পরোয়ানা পেলে সে যেই হোক তাকে ধরব। ’ এক প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, মতিন রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতা। এ কারণে তাকে পুলিশের অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে একচুলও ছাড় দেওয়া হবে না। তাঁর ভাই তুফান এই মামলার প্রধান আসামি। এই মামলায়ও মতিনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে ছাড় নেই। অবশ্য বাদী, এজাহারসহ বিভিন্ন তদন্তে এখনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

ঝাড়ু মিছিল, মানববন্ধন : দোষীদের দ্রুত আইনে বিচার ও ফাঁসির দাবিতে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে শহরের নবাববাড়ী রোডের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের নেতাকর্মীরা ঝাড়ু মিছিল বের করে। মিছিলটি শহর পুলিশ ফাঁড়ি অতিক্রম করার সময় পুলিশি বাধায় পড়ে। এ সময় পুলিশ মিছিলকারীদের কাছ থেকে ব্যানার কেড়ে নেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই মিছিলে জেলা মহিলা দলের সভানেত্রী লাভলী রহমান ছাড়াও শামীমা আক্তার পলিন, শেফালী হক, জেবুন্নেছা জেবা, সুরাইয়া জেরিন রনি, নাজমা আক্তারসহ অন্যান্য নেতাকর্মী অংশ নেয়। বগুড়া শহর টাউন ফাঁড়ি পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত্ত কর্মকর্তা (টিএসআই) ফজলে-ই ইলাহী বলেন, তাদের ব্যানার কেড়ে নেওয়া বা বাধা দেওয়া হয়নি। তবে অনুমতি ছাড়া মিছিল করতে নিষেধ করা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ জেলা শাখা দুপুরে শহরের সাতমাথায় মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। জেলা নারী মুক্তি সংসদের সহসভাপতি দৌলতন বেগমের সভাপতিত্বে ও ফেরদৌসী মীরের সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সালেহা সুলতানা। সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ, জেলা জাতীয় কৃষক সমিতির সভাপতি আব্দুর রউফ, জেলা যুবমৈত্রীর সভাপতি তাইজুল ইসলাম রোম, এনামুল হক বাবলু, সহিদুল ইসলাম সোহেল প্রমুখ।

পরে বিকেল ৫টায় সাতমাথায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি মানববন্ধন করে। মানববন্ধনে জেএসডির সভাপতি আশিষ সরকারের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক গোলাম রব্বানি মন্টু, জেএসডি নেতা মনিরুজ্জামান বাচ্চু, নিয়াজ মুরশেদ টিটু, সুরুতজামান, নাসির উদ্দিন প্রমুখ।

গত ১৭ জুলাই বিকেলে কলেজে ভর্তীচ্ছু ছাত্রীকে ফুসলিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করে বগুড়ার শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার। পরে ২৮ জুলাই তুফানের স্ত্রী আশা, আশার বোন কাউন্সিলর রুমকিসহ সহযোগীরা ধর্ষিতা মেয়েটি ও তার মায়ের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। সূত্র: কালের কণ্ঠ