অতিরিক্ত হ্যাঙ্গার ভাড়া

নতুন সংকটে হেলিকপ্টার পরিবহন ব্যবসা

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

নতুন সংকটে পড়তে যাচ্ছে দেশের হেলিকপ্টার পরিবহন ব্যবসা। নিজস্ব হ্যাঙ্গার থেকে সরিয়ে বেসামরিক হেলিকপ্টার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন জায়গা দিয়েছিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। শুরুতে বলা হয়েছিল, নতুন হ্যাঙ্গারে কয়েক বছর থাকার পর হেলিপোর্ট তৈরি করে সেখানে পাঠানো হবে। সেই প্রক্রিয়া তো শুরুই হয়নি, বরং বর্তমানে সাময়িক সময়ের জন্য থাকা হ্যাঙ্গারের ‘অতিরিক্ত’ ভাড়া চেয়ে বসেছে বেবিচক।

হেলিকপ্টারে যাত্রী পরিবহন করা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তাদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে হ্যাঙ্গার ভাড়া চেয়েছে বেবিচক। এত ভাড়া দিয়ে তাদের পক্ষে এ ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বেবিচকের নির্ধারিত ভাড়াকে ‘অযৌক্তিক’ও বলছেন তারা।

দেশের বেসামরিক হেলিকপ্টার পরিবহন পরিচালনাকারীরা এতদিন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের পূর্বপাশে নিজস্ব (বেবিচক থেকে ইজারা নেওয়া) হ্যাঙ্গারে হেলিকপ্টার রাখতেন। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ পুরোদমে শুরুর পর তাদের সেখান থেকে সরিয়ে রানওয়ে-১৪ এর পূর্ব পাশে (উত্তরা এলাকার দিকে) হ্যাঙ্গার নির্মাণ করে হেলিকপ্টার রাখার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এতদিন তাদের ভাড়া দিতে না হলেও এখন তাদের কাছ থেকে ভাড়া চেয়ে চিঠি দিয়েছে বেবিচক।

সম্প্রতি বেবিচক তাদের জানিয়েছে, হ্যাঙ্গারের ভাড়া হিসেবে প্রথম বছরের জন্য প্রতি বর্গফুট ৪০ টাকা এবং দ্বিতীয় বছরের জন্য ৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৪ সাল থেকে প্রতি বর্গফুটে ৮০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। বেবিচকের এমন সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার অপারেটরদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে দাবি তাদের।

বেবিচক যথেষ্ট পরিমাণ ডিসকাউন্ট দিয়ে ভাড়া ধরেছে। তাদের কাছ থেকে প্রথম ৬ মাস কোনো ভাড়া আদায় করা হয়নি। এরপর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। বিমানবন্দরের একটি লিজ পলিসি রয়েছে (২০১৩ সালের)। এটি অনুমোদিত পলিসি। ওখানে বলা আছে নন-এসি স্থাপনার লিজের জন্য প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৮০ টাকা এবং এসিসহ স্থাপনা ১২০ টাকা। সে পলিসি থেকেও অনেক কম ভাড়া ধরা হয়েছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি হেলিকপ্টার প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের প্রধান এবং প্রধান বৈমানিক ক্যাপ্টেন গুলজার হোসেন  বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল কাওলাতে নতুন হেলিপোর্ট করে আমাদের সেখানে স্থানান্তর করা হবে। সাময়িকভাবে আমাদের নতুন হ্যাঙ্গারে দেওয়া হয়েছে। স্থানান্তরের ২ বছর পর আমাদের বলা হলো আগের ২ বছরের সহ উচ্চমূল্যে ভাড়া দিতে হবে।

তিনি বলেন, একটা হ্যাঙ্গারের মাসিক ভাড়া বর্তমানে ২২ থেকে ২৪ লাখ টাকার মতো লাগছে। আগামী বছর (৮০ টাকা বর্গফুট) এই ভাড়া গিয়ে দাঁড়াবে ৪৪ লাখ টাকায়। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো (যাদের বহরে হেলিকপ্টার সংখ্যা কম) বর্তমানে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শেয়ার করে হ্যাঙ্গারে হেলিকপ্টার রাখছে, তাদের পক্ষে দিগুণ ভাড়া দেওয়া অসম্ভব।

এদিকে হ্যাঙ্গারের এ ভাড়াকে ‘অযৌক্তিক’ বলার পেছনে একটি যুক্তি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের বক্তব্য, বর্তমানে হেলিকপ্টারকে যেসব হ্যাঙ্গার দেওয়া হয়েছে, এটি বড় এয়ারক্রাফট (যাত্রীবাহী বা কার্গো প্লেন) রাখার জন্য তৈরি করা। এগুলোর উচ্চতা প্রায় ৬৫ ফুট। অথচ একটি হেলিকপ্টার রাখতে ১৫ ফুটের হ্যাঙ্গার হলেই চলে। অতিরিক্ত উচ্চতা দেওয়ার কারণে ভাড়াও অতিরিক্ত গুনতে হবে। বর্তমানে যাদের হেলিকপ্টার রাখতে ৬০০-৭০০ বর্গফুট জায়গা লাগে, তাদের ৭ থেকে ৮ হাজার বর্গফুটের হ্যাঙ্গার বরাদ্দ করে রেখেছে।

স্কয়ার এয়ারের পরিচালক-ফ্লাইট অপারেশনস (ডিএফও) ও প্রধান পাইলট সৈয়দ সাখাওয়াত কামাল বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের মাসে ২০-২৫টা ফ্লাইট নেই, অথচ ২০ লাখ টাকা ভাড়া দিতে হবে, এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

তিনি বলেন, আগে আমরা বেবিচক থেকে জায়গা নিয়ে নিজেরা হ্যাঙ্গারের স্থাপনা তৈরি করে জায়গার জন্য একটা ভাড়া দিতাম। প্রতি মাসে আমাদের প্রতি বর্গফুটের জন্য আড়াই টাকা করে দিতে হতো। আমরা এখানেও একইভাবে চেয়েছিলাম। তবে বেবিচক আমাদের বলেছে, তারা স্থাপনা তৈরি করে দেবে আমরা শুধু ভাড়া দেব। এখন আমাদের মোটা অঙ্কের ভাড়া ধরিয়ে দিল। তারা কীসের ভিত্তিতে এমন অযৌক্তিক ভাড়া ধরেছে এটা আমাদের জানা নেই। তবে এটা সত্যি যে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে কয়েকটি হেলিকপ্টার প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব থাকবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, বেবিচক যথেষ্ট পরিমাণ ডিসকাউন্ট দিয়ে ভাড়া ধরেছে। তাদের কাছ থেকে প্রথম ৬ মাস কোনো ভাড়া আদায় করা হয়নি। এরপর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। বিমানবন্দরের একটি লিজ পলিসি রয়েছে (২০১৩ সালের)। এটি অনুমোদিত পলিসি। ওখানে বলা আছে নন-এসি স্থাপনার লিজের জন্য প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৮০ টাকা এবং এসিসহ স্থাপনা ১২০ টাকা। সে পলিসি থেকেও অনেক কম ভাড়া ধরা হয়েছে। হেলিকপ্টার ফ্লাইট পরিচালনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা এই ভাড়া অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয় যদি মনে করে যে ভাড়া কমানো দরকার তাহলে তারা সেভাবে নির্দেশনা দেবে। তাছাড়া এই হ্যাঙ্গারগুলো করা হয়েছে বড় এয়ারক্রাফটের কথা চিন্তা করে। অনেক বিদেশি এয়ারলাইন্স হ্যাঙ্গারগুলো ভাড়া নিতে চাচ্ছে। তাদের কাছে ভাড়া দিলে আমরা ২০০ টাকাও (বর্গফুট প্রতি) ভাড়া পেতে পারি। আমরা হেলিকপ্টার খাতকে রক্ষার স্বার্থে সেগুলো ভাড়া না দিয়ে হেলিকপ্টার রাখতে দিয়েছি।

হেলিপোর্ট তৈরির বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, সরকার প্রায়োরিটি চিন্তা করে প্রকল্প অনুমোদন করছে। আপাতত হেলিপোর্ট প্রায়োরিটিতে নেই।

দেশে ১৯৯৯ সালে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে হেলিকপ্টার-সেবা চালু করে সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স।

আরও পড়ুন : এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ সফিউল আজম বাংলাদেশকে তুলেছেন অনন্য উচ্চতায়

এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) তথ্য মতে, দেশে ১০টি বেসরকারি কোম্পানির ৩২টি হেলিকপ্টার আছে। কোম্পানিগুলো হলো, বিসিএল এভিয়েশন, ইমপ্রেস এভিয়েশন, আর অ্যান্ড আর এভিয়েশন, স্কয়ার এয়ার লি., মেঘনা এভিয়েশন, বসুন্ধরা এয়ারওয়েজ, বিআরবি এয়ার, এরো টেকনলজিস, সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন হোটেল, হাসপাতাল ও ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড থাকলেও কয়েকবছর ধরে এসব হেলিপ্যাডে উড্ডয়ন ও অবতরণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে লিখিত কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে বেবিচক সূত্র বলছে, বিমানবন্দর ছাড়া কোথাও হেলিকপ্টার অবতরণের অনুমতি না দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমন নির্দেশনার কারণ হিসেবে ‘নিরাপত্তার হুমকি’, ‘মাদক পাচার’ ও ‘ভবন ধসের’ আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আমাদের বলা হয়েছিল কাওলাতে নতুন হেলিপোর্ট করে আমাদের সেখানে স্থানান্তর করা হবে। সাময়িকভাবে আমাদের নতুন হ্যাঙ্গারে দেওয়া হয়েছে। স্থানান্তরের ২ বছর পর আমাদের বলা হলো আগের ২ বছরের সহ উচ্চমূল্যে ভাড়া দিতে হবে। একটা হ্যাঙ্গারের মাসিক ভাড়া বর্তমানে ২২ থেকে ২৪ লাখ টাকার মতো লাগছে। আগামী বছর (৮০ টাকা বর্গফুট) এই ভাড়া গিয়ে দাঁড়াবে ৪৪ লাখ টাকায়।

তবে ভবন বা হোটেলের হেলিপ্যাডে অবতরণের অনুমতি না পাওয়ায় অনেক মুমূর্ষু রোগী সময় মতো চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হেলিকপ্টার প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, একজন মুমূর্ষু রোগীকে যদি রংপুর থেকে জরুরিভাবে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তির জন্য ঢাকায় আনার প্রয়োজন হয়, ১ ঘণ্টার মধ্যে হেলিকপ্টার গিয়ে তাকে আনতে পারবে। তবে ওই রোগীকে নিয়ে হেলিকপ্টার নামে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এমন অনেক ঘটনা দেখেছি যে রোগী ১ ঘণ্টায় ঢাকায় এসেছে তবে যানজটের কারণে বিমানবন্দর থেকে হাসপাতাল যেতে ২-৩ ঘণ্টা লেগে যায়।

এদিকে বেবিচক বলছে, জুলাই মাসেই এ সংকট কেটে যাবে। চলতি মাসের মধ্যেই বিমানবন্দর ছাড়াও অন্যান্য হেলিপ্যাডে হেলিকপ্টার অবতরণের অনুমতি দেওয়া হবে।

বর্তমানে হেলিকপ্টার পরিচালনার অন্যতম বড় সমস্যা ঘুড়ি। হেলিকপ্টারের পাইলটরা জানান, বাংলাদেশের বেসামরিক হেলিকপ্টারগুলোর চলাচলের জন্য ভূমি থেকে ৫০০ ফুট ও এক হাজার ফুট উচ্চতা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তবে বর্তমানে হেলিকপ্টার চলাচলের সময় প্রায়ই সমস্যার তৈরি করে লম্বা সুতার ঘুড়ি। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। অধিকাংশ সময় গাজীপুর, পূর্বাচল ও আশুগঞ্জে ঘুড়ি ওড়ানোর কারণে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় পাইলটদের।

সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের চিফ পাইলট গুলজার হোসেন  বলেন, আগে দেশে ওড়ানো ঘুড়িগুলো সর্বোচ্চ ৩০০ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। সম্প্রতি প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেকে লম্বা সুতা ব্যবহার করে দেড় হাজার ফুট পর্যন্ত আকাশ সীমায় ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, যা হেলিকপ্টার উড্ডয়নের জন্য বিপজ্জনক। ঘুড়ি ওড়ানোতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের সুতা অনেক শক্ত। হেলিকপ্টারের পাখার সংস্পর্শে এলে না ছিঁড়ে উল্টো জড়িয়ে যাচ্ছে, যা হেলিকপ্টারের নিরাপদ উড্ডয়নের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে।

২০২০ সালে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) ঘুড়ি ওড়ানোর বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছিল। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ড্রোন, রিমোটলি পাইলটেড এয়ারক্রাফট সিস্টেম, রিমোট কন্ট্রোলড খেলনা বিমান ও ঘুড়ি ওড়াতে অনুমতি লাগবে। অনুমোদন ছাড়া এগুলো ওড়ানো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি ঝুঁকি বলে বিবেচিত হচ্ছে। অনুমোদন ছাড়া ওড়ানোর ফলে নিয়মিত যাত্রীবাহী দেশি-বিদেশি বিমান, হেলিকপ্টার এবং দ্রুতগতির সামরিক বিমানের আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।