নওগাঁয় চাল মিলারদের সাথে চুক্তি হয়নি, কৃষকদের ধান কেনার দাবি

কাজী কামাল হোসেন,নওগাঁ:
চলতি আমন মৌসুমে চাল সংগ্রহ কার্যক্রমের আওতায় সরকার খাদ্য উদ্বৃত্ত নওগাঁ থেকে ১৩ হাজার ২৮৯ মেট্রিক টন চাল মিলারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে। কৃষকদের কথা চিন্তা ভাবনা না করেই সংশ্লিষ্ট বিভাগ গত মাসের ২৬ তারিখে চাল মিলারদের কাছ থেকে ৩৩ টাকা কেজি দরে চাল কেনায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ দিকে জেলার মিলারদের সিন্ডিকেটে বর্তমান বাজারে মোটা জাতের ধান দাম না থাকায় বর্গ চাষিদের দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে এমনটিই জানিয়েছেন কৃষকরা। গত ছয় দিনেও জেলার কোন চাল মিলারদের সাথে চুক্তি শুরু করা সম্ভব হয়নি নওগাঁয়। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন সরকারি সময় চলতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যেই চুক্তি সম্পন্ন হবে।

 
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সত্যব্রত সাহা সিল্কসিটি নিউজকে জানান, খাদ্যে উদ্বৃত্ত নওগাঁয় চলতি আমন মৌসুমে উদশী (চিকন) ও স্থানীয় (মোটা) জাতের ১ লাখ ৯৬ হাজার ৬৪ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্য মাত্র নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আবহাওয়া আমন ধান চাষে অনুকুলে থাকায় ২ লাখ ১ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় (মোটা) জাতের ধান ২২ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর ধানের উৎপাদনও ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই কৃষিবিদ।

 
জেলা খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে নওগাঁ সদরে ৫ হাজার ৫২২ মেট্রিকটন, আত্রাইয়ে ৩৮৪ মেট্রিকটন, রাণীনগরে ১ হাজার ৬৪ মেট্রিকটন, মহাদেবপুরে ৪ হাজার ৩৭৬ মেট্রিকটন, পত্নীতলায় ৪৭০ মেট্রিকটন, বদলগাছীতে ১৭৩ মেট্রিকটন, ধামইরহাটে ২৯৩ মেট্রিকটন, সাপাহারে ৮ মেট্রিকটন, পোরশায় ২৬৬ মেট্রিকটন, মান্দায় ২৬৬ মেট্রিকটন ও নিয়ামতপরে থেকে ৩৮০ মেট্রিকটন চাল কেনবে খাদ্য মন্ত্রাণালয়।

 
নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুস সোবহান জানান, গত ইরি-বোরো মৌসুমে প্রান্তিক কৃষকরা সরকারি গুদামে সরকারের নির্ধারিত ২৩ টাকা দরে সরাসরি ধান দিতে পারায় ধানের ভালো দাম পেয়েছেন। চলতি আমন মৌসুমে সরকারি গুদামে জেলার কৃষকরা ধান বিক্রি করবে এমন আশায় মোটার জাতের ধান চাষ করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণালয় হঠাৎ করে শুধু মাত্র চাল (চাতাল) ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চলে কেনার সিদ্ধান্ত নেয়ায় হতাশা হয়েছে। এতে তাদের লোকসান গুণতে হবে।

 
একই গ্রামের আবুল কালাম, কুদ্দুস আলী, মোবারক সরদার জানান, এক বিঘা জমি আমন ধান চাষ করতে ৮ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। আর মোটা জাতের আমন ধান ১২/১৫ মণ উৎপাদন হয়। বর্তমানে সাড়ে ৭শ’ থেকে ৭শ’ ৬০ টাকা প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে বাজারে। এই হিসেব থেকে প্রতি বিঘায় ১০ থেকে ১১ হাজার টাকায় আসছে। কিন্তু বর্গ চাষিদের জমির মালিক অর্ধেক ধান দিয়ে প্রতি বিধায় দেড় থেকে দুই হাজার লোকশান গুণতে হচ্ছে।

 
কৃষকরা জানিয়েছেন প্রান্তিক কৃষকরা যখন ধান মাড়াই শুরু করে তখন সরকার ধান-চাল কেনা শুরু করে না। যখন মধ্যস্বত্তভোগীদের হাতে যখন ধান চলে যায় তখন সরকার ধান-চাল কেনা শুরু করে। এতে প্রতি বছর কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ্য হলেও মধ্যস্বত্তভোগীরা লাভবান হয়ে যায়।

 
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নওগাঁর সমন্বায়ক জয়নাল আবেদিন মুকুল জানান, কৃষিকে বলা হয় বাংলাদেশ প্রাণ। দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ কৃষির সাথে জড়িত। আর নওগাঁয় ৩০ লাখ লোকের মধ্যে ২৭ লাখ লোক কৃষির সাথে জড়িত। অপরদিকে জেলায় ১২শ’ মিল রয়েছে। সারা দেশের ৩০ জনের মতো চাল ব্যবসা এ ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে নওগাঁর ১২ জন চাল ব্যবসায়ী ধান-চাল ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন। লাখ লাখ কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল না কিনে চাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাল কেনার অর্থ কৃষিশিল্পকে ধ্বংস করা।

 
প্রতি বছর মৌসুমেই ধান কাটা মাড়াইয়ে দেরি করে সরকারি ধান-চাল শুরু করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি  বলেন, চাল ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেতেই দেরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণালয় ধান-চাল কেনা শুরু করে। তাই দ্রুত খাদ্য মন্ত্রাণালয়কে ঢেলে সাজিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ও চাল কেনার দাবি জানিয়েছেন।

 
জেলা চাউল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চাতাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করে সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, চাল ব্যবসায়ীদের সাথে সরকার চলতি মাসের ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে চুক্তি নির্দেশণা হয়েছে। চুক্তি শেষে আগামী বছরের ১৫মার্চ পর্যন্ত চাল গুদামজাত করা হবে। দ্রুত সরকারি গুদামে চাল সরবরাহ শুরু করা হবে।

 

তিনি আরও বলেন, প্রতি কেজি চাল ৩৩ টাকা দরে কেনার এই সিদ্ধান্ত সরকারের সময় উপযোগি সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেন।

 
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস ছালাম সিল্কসিটি নিউজকে জানান, চলতি মাসের পহেলা তারিখে সন্ধ্যায় সরকারি নির্দেশণা হাতে পাওয়ারপর জেলা ও উপজেলায় মিলার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা শুরু হয়েছে। মিলারদের মধ্যে বরাদ্দ অর্থাৎ বিভাজন করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জেলার মিলারদের সাথে চুক্তি শেষে চাল গুদামজাত শুরু করা হবে।

 
এ ছাড়াও কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার দাবি উধ্বর্তন বিভাগে জানিয়ে দেবেন এমনটিই জানিয়েছেন জেলার এ খাদ্য কর্মকর্তা।

 
প্রতি বছর খাদ্য উদ্বৃত্ত নওগাঁয় প্রায় ৮৪ ভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়। আর নওগাঁ থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ১২ লাখ মেট্রিকটন ধান-চাউল সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

স/শ