ধান-চাল মজুদে মজেছে নাটোরের মিল মালিকরা: মাঠে জেলা প্রশাসন

মাহবুব হোসেন, নাটোর:
গোডাউনে পর্যাপ্ত ধান-চাল মজুদ থাকলেও কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে নাটোরের মিল মালিকরা। বর্তমানে গোডাউনে হাজার হাজার টন চাল এবং ধান মজুত থাকলেও ইচ্ছা মতো চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে তারা। আজ শনিবার সরেজমিনে বিভিন্ন অটো রাইস মিলে ঘুরে এসব চিত্র ফুটে উঠে।

তবে মিল মালিকরা বলছে, মিলে পর্যাপ্ত পরিমানে ধান সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারনে বেশি দামে ধান ক্রয় করার কারনে চাল উৎপাদনে খরচ পড়ছে বেশি। আর উৎপাদন খরচ বেশি পড়ার কারনে চালের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে, অবৈধ ভাবে ধান এবং চাল মজুদ রাখার বিষয়ে মাঠে নেমেছে জেলা প্রশাসন। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া বিশেষ এই অভিযানে জেলা প্রশাসনের একটি ভ্রাম্যমান আদালত। গত দুই দিনে ধান এবং চাল মজুদ রাখা সহ বিভিন্ন অপরাধে চারজন মিল মালিকদের বিরুদ্ধে জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত।

শনিবার বড়াইগ্রাম উপজেলার গড়মাটি এলাকায় স্থাপিত রশিদ অটো রাইস মিলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই অটো রাইস মিলের অন্তত ৮ থেকে ১০টি গোডাউনে পর্যাপ্ত পরিমানে চাল এবং ধান মজুদ রয়েছে। প্রতিটি গোডাউনে ধান এবং চালে ঠাসা রয়েছে। চাল উৎপাদন করে মজুদ রেখেছে মিলটির কর্তৃপক্ষ। এছাড়া কম দামে ধান কিনে মজুদ রাখা হয়েছে মিলটিতে। ১৩হাজার টন ধান এবং ৩হাজার টন চাল ধারন ক্ষমতা সম্পূর্ন মিলটিতে বর্তমানে ধান মজুদ রয়েছে ৩হাজার টন এবং চাল মজুদ রয়েছে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টন। ১৫দিন পরপর খাদ্য বিভাগের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও না করায় এবং সরকারি খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহের তালিকাভূক্ত হওয়ার পরেও চাল সরবরাহ করেনি মিলটি।

মিলটির একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ। এই মালিকের নাটোরের ‘গড় মাটি’ এছাড়াও কুষ্টিয়ায় ৪টি এবং অন্যাণ্যে স্থানে আরো ৪টি মিল রয়েছে। মোট ৮ থেকে ১০টি মিলের মালিক তিনি। বর্তমানে সবগুলো মিলে পর্যাপ্ত পরিমানে ধান এবং চাল মজুদ রয়েছে বলে জানান নাটোর মিলের এক কর্মচারী।

গড় মাটি এলাকায় স্থাগিত রশিদ অটো রাইস মিলের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর জহুজুর হক দাবী করে সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, কোন মিলেই তাদের অতিরিক্ত মজুদ নাই। চাহিদা পত্র অনুযায়ী ধান এবং চাল সরবরাহ করছে তারা। প্রতিদিন নাটোরের মিল থেকে ৬০ থেকে ৬৫টি ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। ফলে মজুদ রাখার প্রশ্নই আসে না।

চালের উর্দ্ধগতির বিষয়ে তিনি আরো বলেন, বর্তমানে সাড়ে ১২০০থেকে ১৪০০ টাকা মনে ধান ক্রয় করতে হচ্ছে। এরসাথে পরিবহন খরচ এবং সাটারিং খরচ রয়েছে। যার কারনে একমন চাল উৎপাদন করতে গিয়ে দ্বিগুণ খরচ গুনতে হচ্ছে। আর অধিক মূল্য ধান ক্রয় করার কারনেই বাড়ছে চালের দাম।

অরপদিকে, বনপাড়া-ঢাকা মহাসড়কের পার্শ্বে গড়া উঠা আরেকটি গাজী অটো রাইস মিল। এই মিলটিতেও মিলেছে পর্যাপ্ত ধান এবং চাল মজুদ রাখার বিষয়টি। এছাড়া এই মিলটি বিভিন্ন বেনামী কোম্পানীর চাল সাটারিং করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

সারা দেশের মতো নাটোরেও হঠাৎ করেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে চালের দাম। গত সপ্তাহে বিভিন্ন চালের দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ৬ থেকে ৭টাকা। যার কারনে চাল ক্রয় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। হঠাৎ করেই দেশের মতো নাটোরের চালের বাজার উর্দ্ধগতির বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে নাটোরের জেলা প্রশাসন। গত দুই দিনে চারটি মিলে অভিযান পরিচালনা করে ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক মোর্তুজা খান। এসময় অবৈধ ভাবে ধান এবং চাল মজুদ রাখা বিষয়টি নজরে আসে তার। গত দুই দিনে ধান এবং চাল মজুদ রাখা সহ বিভিন্ন অপরাধে নাটোর অটো রাইস মিলকে ৩০হাজার টাকা, রশিদ অটো রাইস মিলকে ৫০হাজার, গাজী অটো রাইস মিলকে ৫০হাজার এবং অন্য আরেকটি মিলকে ১০হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত। এছাড়া অবৈধ দাম চাল মজুদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষনা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

অভিযানে নেতৃত্বদানকারী নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলাম সিল্কসিটি নিউজকে জানান, শনিবার নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার গড়মাটি এলাকার রশিদ অটোরাইস মিল এবং বনপাড়ার গাজী অটোরাইস মিলে অভিযান চালানো হয়। এসময় তাদের উৎপাদিত চালের বস্তায় উৎপাদনের তারিখ এবং বিক্রয় মূল্য লেখা না থাকায় এবং ১৫দিন পরপর খাদ্য বিভাগের কাছে প্রতিবেদন দাখিল না করায় এবং সরকারি খাদ্য গুদামে চাল সরবরাহ না করায় ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে ওই দু’টি রাইস মিলকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, দেশে এমন কিছু হয়নি যে চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। কিন্তু অটো মিল মালিকরা তাই করছে। গোডাউনে পর্যাপ্ত ধান এবং চাল মজুদ থাকলেও তারা বাজারে সরবরাহ করছে না। প্রাথমিক ভাবে তাদের জরিমানা করে সতর্ক করা হয়েছে। এরপরও যদি তারা অপরাধ করে তাহলে গোডাউন সীলগালা করে বাজারে চাল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হবে।

সূত্র জানায়, গত বোরো মৌসুমে উত্তরের জেলা নাটোরে প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া সম্প্রতি বণ্যায় এই জেলায় সাড়ে ১১হাজার হেক্টর জমির রোপা-আমন ধান বিনষ্ট হয়েছে। যার কারণে সরবরাহ কমে গেছে ধানের। বর্তমানে বাজারে মিনিকেট ধান সাড়ে ১৩’শ থেকে ১৪’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মোটা ধান সাড়ে ১১’শ থেকে সাড়ে ১২’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জেলা মার্কেটিং অফিসার নূর মোমেন বলেন, গত এক সপ্তাহে নাটোরের বাজারে প্রতি কেজি চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি কেজি চালের অন্তত ৬ থেকে ৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং চালের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য ধান সংকটকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা।

জেলা কনজুমার এস্যোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রইস উদ্দিন সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, হাওয় অঞ্চল ফসল নিমজ্জিত হওয়ার পর থেকে চালের বাজার উর্দ্ধগতির দিকে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের মধ্যে চলনবিলে বোরো ধান এবং সম্প্রতি রোপা-আমন ধান নিমজ্জিত হওয়ার কারনে ধান সংকট প্রকট হয়েছে। নতুন করে বাজারে ধান না আসলে এই সংকট থেকেই যাবে।

তিনি আরো বলেন, চালের উর্ধ্বগতির বাজার নিম্নগামী করতে সরকারকে পর্যাপ্ত পরিমানে চাল আমদানী এবং ওএমএস চালু করা বিশেষ দরকার। না হলে সাধারণ মানুষে ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চালের বাজার চলে যাবে।

এ ব্যাপারে নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন সিল্কসিটি নিউজকে জানান, হঠাৎ করেই চালের বাজার উর্ধমুখি হওয়ায় এই অভিযান শুরু করা হয়েছে। চাল ব্যবসায়ীরা যাতে কারসাজি বা সিন্ডিকেট করে কোন ভাবে চালের দাম বাড়াতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রেখেই এই বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে এবং এটা অব্যাহত থাকবে।

তিনি আরো জানান, সরকারী নিয়ম-কানুন মেনে সুষ্ঠভাবে ব্যবসা করলে কারো বিরুদ্ধেই কোন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবেনা।

স/অ