ধর্ষণ, সমাজ ও আইন

নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক একটি পবিত্র অধ্যায়, কেননা সৃষ্টির শুরু থেকে এই মাধ্যমেই মানবজাতির বিস্তৃতি ঘটেছিল, ঘটছে এবং ভবিষ্যতে ঘটবে। অথচ এই সম্পর্ক নিয়ে আমরা কথা বলতে লজ্জা পাই বিব্রত বোধ করি। আমরা গভীরভাবে ভাবতে পারি না আমি আপনি আমরা আপনারা এই তাবৎ প্রাণীকূল এই মাধ্যমেই পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেছি। তবে কেন এই পবিত্র সম্পর্ক নিয়ে এতো অনাচার? কেন এই পবিত্র সম্পর্ক ধর্ষণে রুপান্তরিত হয়ে যায়!

শুধু যৌন আকাঙ্খার জন্য ধর্ষণ হয় না। এখানে পারিবারিক শিক্ষা, মাদক, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, বিচারহীনতা, আইনের শাসন ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ইত্যাদি দায়ী। সিলেট এমসি কলেজে তুলে নিয়ে ছাত্রাবাসে ধর্ষণ, একই দিনে পাহাড়ে মা-বাবাকে বেঁধে পাহাড়ি তরুণীকে ধর্ষণ, তারপরেই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ঘটে গেলো সেই রোমহর্ষক ঘটনা। বিবস্ত্র করে নারী নির্যাতন, ভাইরাল হওয়া এই ভিডিও কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না। ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে একজন নারীকে উলঙ্গ করে যত রকমের নৃশংস কায়দায় নির্যাতন ও উল্লাস করা যায় তা করেছে স্থানীয় দেলোয়ার বাহিনী।

প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে কিংবা টেলিভিশনে ধর্ষণের খবর গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। এনজিওগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৮৯টি। বিশ্বের যেসব দেশে দুর্নীতি একেবারে নেই, সভ্যতা পরিপূর্ণ, শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায় বিচারে যারা ভালো অবস্থান নিয়ে আছে সেসব দেশেও ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন হচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২০সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ডে প্রতি এক লাখ জনগণের মধ্যে ৭৭.৫ জন নারী ধর্ষিত হয়। সুইডেনে এই হার ৬৩.৫, অস্ট্রেলিয়ায় ২৮.৬, বেলজিয়ামে ২৭.৯, যুক্তরাষ্ট্রে ২৭.৩, নিউজিল্যান্ডে ২৫.৮, নরওয়ে ১৯.২, ফ্রান্সে ১৬.২, ফিনল্যান্ডে ১৫.২, অস্ট্রিয়ায় ১০.৪, জার্মানিতে ৯.৪ ও নেদারল্যান্ডে ৯.২।

 

ইউরোপ-আমেরিকার এই সকল দেশের জনগণ অনেক সভ্য। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত না। অথচ ধর্ষণের হার অনেক বেশি।বাংলাদেশে এই হার ৯.৮২। সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে প্রতি এক লক্ষ নারীর মধ্যে ১৩২.৪ জন ধর্ষিত হয়। সবচেয়ে কম মিশরে ০.১০। জাপানে ১.০, নেপালে ০.৮, ভারতে ১.৮। এখানে ধর্ষণের হার কেন দক্ষিণ আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশি কিংবা মিশরে সবচেয়ে কম? শুধুই কি আইন? সামাজিক অবক্ষয় কি দায়ী নয়? কঠোর আইন একটি সমাজের জন্য ভীষণ প্রয়োজন কিন্তু শুধু আইন একটি সমাজ বদলাতে পারে না। আইন মানুষের মনে ভয়-ভীতির সঞ্চার করতে পারে কিন্তু মূল্যবোধ তৈরি করতে পারে না। সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ই ধর্ষণ ও নারীর প্রতিসহিংসতার প্রধান কারণ।

আমরা খুব সহজেই নারীর পোশাকের দিকে আঙুল তুলি কিন্তু এই সমাজে হিজাব পরিহিতা নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এই ফলশ্রুতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা তো নিম্নগামী হবার কথা ছিল তবুও বাড়ছে। সমস্যার গোঁড়ায় যদি যাই তবে দেখা যাবে জন্ম থেকেই শিশু মনে ছেলে মেয়ের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়া হয়। মেয়েরা বেড়ে ওঠার সময় সে মা-বোন, দাদি-চাচির অনেকের সান্নিধ্য পায়- যেটি তার বেড়ে ওঠায় শিক্ষাদীক্ষায় সাহায্য করে। মেয়েটির ভালো গ্রুমিংয়ে সবাই সচেতন থাকে কিন্তু কেউভাবে না ছেলেটির গ্রুমিং এর প্রয়োজন আছে- তারও বাবা, বড় ভাই, চাচা সর্বোপরি পরিবারের সকল সদস্যার সান্নিধ্য পাওয়ার অধিকার আছে। আমাদের দেশে বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে পরিবারের অসচেতনতা ছেলে শিশুটি নষ্ট হবার জন্যেও দায়ী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রেফতারকৃত ধর্ষককে দেখা যায় মাদকাসক্ত। একজন মাদকাসক্ত অমানুষ কখনো বিবেক সমৃদ্ধ কাজ করবে না তার দ্বারা বিবেক বহির্ভূত কাজটাই সম্ভব।

নিত্যনতুন মাদকে বাজার সয়লাব। বর্তমানে মাদক মাকড়শার জালের মত ছড়িয়ে পড়েছে সমাজে যা তাদের মস্তিষ্ককে বিকৃত করে তুলছে। বিকৃত মস্তিষ্ক দ্বারা যে কোন অন্যায় হওয়াটা স্বাভাবিক। বিচার-অবিচার পাওয়া, না পাওয়া কোন ভারসাম্যতা তার মস্তিষ্কে নেই সুতরাং ধর্ষণের হার কমানোর জন্য প্রয়োজন জিরো টলারেন্সে মাদক নিয়ন্ত্রণ। এর দ্বারা শুধু ধর্ষণ নয় সমাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুফল পাবে। প্রয়োজন নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা। সুস্থ পারিবারিক পরিবেশে সন্তানের বেড়ে ওঠাকে নিশ্চিত করা। পরিবারের ছেলে মেয়ে উভয়কেই পড়াশোনার বাইরেও ভালো ভালো কাজে উৎসাহ দেয়া যা তাদের সুস্থ মস্তিষ্ক বিকাশে সাহায্য করবে। প্রয়োজন আইনের শাসনকে কার্যকর করা এবং কঠোর আইনের মাধ্যমে বিচার কাজ পরিচালনা করা। নারী-পুরুষ পারস্পারিক বিদ্বেষ নয় প্রয়োজন কাধে কাধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তবেই সম্ভব একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ ও একটি সুস্থ সুন্দর দেশ গড়ে তোলা।

লেখক : রিসার্চ এক্সিকিউটিভ, ইন্সটিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (আইক্লডস)।

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন