ফেসবুক মেসেজের বাক্সে এক তরুণীকে চূড়ান্ত অশ্লীল ছবি পাঠিয়ে ‘যৌন আলোচনার’ প্রস্তাব রেখেছিল এক যুবক। বিষয়টির ফেসবুকে পোস্ট করে সকলকে জানানোর কথা বলেন তরুণী। তাতেই এল ধর্ষণের হুমকি। সরাসরি। গোটা বাক্যালাপের ‘স্ক্রিনশট’ সোমবার রাতে ওই তরুণী ফেসবুকে পোস্ট করে দেন। দেখা যায়, এক যুবক যৌনাঙ্গের ছবি পাঠিয়েছে মেসেজ বাক্সে। তার পরেই রয়েছে ‘ধর্ষণ করে খালে ফেলে দেওয়ার’ হুমকি। ফেসবুক প্রোফাইল বলছে, ওই যুবক কলেজে পড়ে।

মঙ্গলবার গোটা বিষয়টি কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে জানান ওই তরুণী। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযোগটি সাইবার ক্রাইম থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত চলছে। প্রাথমিক ভাবে অভিযুক্তের আইপি অ্যাড্রেস (ইন্টারনেট প্রোটোকল) দিয়ে তাকে শনাক্ত করা হবে। সেই সঙ্গে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে ওই অভিযুক্তের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চাওয়া হবে, যাতে ওই প্রোফাইলটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

বস্তুত, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ফেসবুকে প্রায় প্রতিটি মহিলার মেসেজ বাক্স হাতড়ালে এমন কুরুচিকর ও অশ্লীল মেসেজ না মেলাটাই যেন বিরল ব্যাপার। আর এই প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে বলেই জানাচ্ছেন অনেকে। দক্ষিণ কলকাতার এক তরুণী জানালেন, তিনি বছর চারেক ফেসবুক করছেন, এ রকম যৌনাঙ্গের ছবি বা অশ্লীল ভাষায় সরাসরি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার প্রস্তাব ইনবক্সে কম জমেনি। তিনি এড়িয়ে যান অথবা ব্লক করে দেন। ‘‘কিন্তু একটা সময়ের পরে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে।’’— স্বীকার করলেন ওই তরুণী।

বিশেষজ্ঞদের মত, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই হেনস্থা, যা ‘সাইবার ক্রাইম’-এর পর্যায়ে পড়ে, তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত বছর অগস্ট মাসেই তাঁকে ফেসবুকে যৌন হেনস্থা করা হয়েছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন গায়িকা সাহানা বাজপেয়ী৷ তাঁর অভিযোগ ছিল, একটি ভুয়ো প্রোফাইল থেকে তাঁর উদ্দেশে কুরুচিকর মন্তব্য করা হচ্ছে। ফেসবুকে ঘটনাটি পোস্ট করার পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের সাইবার সেলেও অভিযোগ জানান গায়িকা। সাহানা এ দিন লন্ডন থেকে জানালেন, এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। তাই পুলিশের কথামতো শান্তিনিকেতন থানাতেও অভিযোগ দায়ের করেন। এর মধ্যে ওই একই নামের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে টুইটারেও তাঁকে কুরুচিকর মেসেজ করা হয়। সাহানা জানিয়েছেন, পুলিশকে সে সময়ে বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে জানান তিনি।

সাহানা বলেন, ‘‘যে-হেতু সোশ্যাল মিডিয়ায় শারীরিক ভাবে কারও নাগাল পাওয়া যায় না, তাই এই কুকীর্তিগুলো ঘটেই চলেছে মহিলাদের সঙ্গে। কখনও অশ্লীল কথা বলে, কখনও বা কুপ্রস্তাব দিয়ে।’’

তবে নভেম্বর মাসে শহরের এক মহিলার অভিযোগ ছিল, তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তি ফেসবুকে অশ্লীল মেসেজ পাঠিয়ে তাঁকে উত্ত্যক্ত করছেন। একাধিক বার বারণ করা সত্ত্বেও তিনি থামেননি। তখন ওই মহিলা সাহায্য চান কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে। পুলিশ কিছু দিনের মধ্যেই বিরাটি থেকে গ্রেফতার করে অভিযুক্তকে।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত এমন ঘটনায় সরাসরি পুলিশের কাছে যাওয়াই উচিত বলে মনে করেন। তিনি জানালেন, যদি কেউ আপত্তিকর মেসেজ করে, তা মুছে ফেলা উচিত নয়। প্রমাণ রাখা দরকার। সম্পূর্ণ অচেনা কারও বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ না করাই ভাল, অনেক সময় মহিলাদের ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেলের ঘটনাও ঘটে। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ‘পাবলিক’ করে পোস্ট করা নিয়েও সতর্ক থাকা দরকার। অভিজ্ঞদের মতে, অনেক সময় দেখা যায় ঘটনাগুলির সঙ্গে পূর্ব পরিচিতেরা জড়িত। তাই প্রায়ই বেশি দূর এগোতে চান না অভিযোগকারীরা।

গত বছর মার্চ মাসেই মাইক্রোসফটের ‘ডিজিটাল সিভিলিটি ইনডেক্স’ বা অনলাইনে ভদ্রতার সূচক বলেছিল, অনলাইনের অসভ্যতা, হেনস্থা, অশ্লীলতার ঘটনায় চোদ্দোটি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে সপ্তম স্থানে। একটি সমীক্ষায় ৭৭ শতাংশ ভারতীয় জানান, অনলাইন বুলিং, হেনস্থা, ট্রোল— এ সব একাধিক ঘটনার শিকার হয়েছেন তাঁরা। তার মধ্যে ৭০ শতাংশ মহিলা জানান, ইন্টারনেটে বিভিন্ন রকমের হেনস্থার আশঙ্কায় ভোগেন। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় অসম্মানজনক কথা, প্রতিহিংসামূলক মানসিক নিগ্রহের মতো বিপদের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে বলে মনে করেন অনেকেই। এর সঙ্গে এখন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গিয়েছে যৌন হেনস্থার ঘটনা।

তথ্য-পরিসংখ্যানও এই ঝুঁকির কথা তুলে ধরছে। নেট-নির্ভর প্রজন্মের পিলে চমকে দিয়ে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো জানিয়েছে গত দশকে দেশে ১৯ গুণ বেড়েছে সাইবার অপরাধ। নেট যোগাযোগের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে এ সব সমস্যা আরও বাড়বে, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা। আনন্দবাজার