ধর্ষকের জাতপাত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কেন?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের বিচার চেয়ে গত এক সপ্তাহ প্রকম্পিত ছিল ক্যাম্পাস। ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অবশেষে ধর্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এতে আশ্বস্ত হয়েছেন কেউ কেউ। আবার কোথাও কোথাও এই ধর্ষককে নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি আদৌ ধর্ষক কি না। তাঁরা বলছেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে কীভাবে একজন ভবঘুরে ধর্ষণ করতে পারেন? ধর্ষকের শরীরের গড়ন দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটির ওপর জোর খাটানোর মতো শক্তি তাঁর নেই। ধর্ষক ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। তা ছাড়া, যে জায়গায় ছাত্রীটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তা সুরক্ষিত একটি জায়গা। সেখানে এ রকম একজনের পক্ষে মেয়েটিকে ধর্ষণ করা সম্ভব কি না।

ধর্ষণের শিকার ছাত্রীটি বলেছেন, ধর্ষকের সামনের দুটো দাঁত নেই, তাঁর পরনে পুরোনো প্যান্ট এবং কালো রঙের জ্যাকেট ছিল। ধর্ষক বেশ দাম্ভিকও, তিনি মেয়েটি কোথায় পড়েন, তা জানতে চেয়েছেন। সেই ধর্ষকের জোর থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। সেদিক থেকে খটকা লেগেছে অনেকের। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির পক্ষে এগুলো জিজ্ঞাসা করা সম্ভব কি না? একজন ভবঘুরের, কিছুটা দেখতে ‘অপ্রকৃতিস্থ’ ব্যক্তির এতটা সাহস হওয়ার কথা নয়…ইত্যাদি।

সাহস নিয়ে যাঁরা এই সব কথা বলছেন, তাঁদের বলি, যেকোনো শ্রেণির পুরুষের পক্ষে পুরুষতান্ত্রিকতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব। তাঁরা যদি মনে করেন, ধর্ষকের শ্রেণি আছে, সেটিও ঠিক নয়। ধর্ষক দেখতে সুঠামদেহী হবে কিংবা চেহারা সিনেমায় দেখা ‘ভিলেন’ টাইপের হবে, সেটিও কিন্তু নয়, ধর্ষক আমার-আপনার আশপাশের পরিচিত যে কেউই হতে পারে। ধর্ষণের শিকার নারীর সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ধর্ষকের চেহারা কল্পনা করা ঠিক নয়। সবদিক থেকে ক্ষমতাহীন একজন পুরুষ একজন ক্ষমতাবান নারীকে ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানি করতে পারেন, তাঁর একটিমাত্র ক্ষমতার জন্য, আর সেটি হলো পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা। এই একটি ক্ষমতা তাঁকে অন্য সব ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ক্ষমতাবান করে। আর সে কারণেই ধর্ষকের কোনো শ্রেণি নেই, ধর্ম নেই, জাত নেই। আর সেই কারণেই যুদ্ধ, সংঘাতে ধর্ষণ সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে কাজ করে।

গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিটিই প্রকৃত অপরাধী কি না, সেটি নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করার আরও কিছু কারণও সামনে এসেছে। অনেকেই বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতার কারণে এমনটি ঘটছে। এর পেছনে ঐতিহাসিক এবং বাস্তব কারণ আছে। আমাদের মেনে নিতে হবে যে এই অবিশ্বাস এক দিনে জন্ম নেয়নি বা একটা-দুটি ঘটনা থেকে জন্মেনি। বিশেষ করে মানবাধিকারকর্মীদের অনেকে এমন বিতর্কের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থার অভাবকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন।

এই ধর্ষক গ্রেপ্তারের আলোচনায় বারবার এসেছে জজ মিয়ার নাম। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জজ মিয়া নামের এক যুবককে দিয়ে আদালতে হামলার দায় স্বীকার করানো হয়। আরও নজির আছে, অভিযুক্ত না হয়েও জাহালম নামের একজন ব্যক্তি একটি মামলায় ১০ বছর কারাগারে ছিলেন। আর এ দেশে আসল অভিযুক্তকে বাদ দিয়ে অন্যকে গ্রেপ্তারের অনেক ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। তারা যা বলছে, তার সবটা মানুষ বিশ্বাস করছে না।

তবে ধর্ষণকারী যে–ই হোক না কেন, সমাজের যে শ্রেণির মানুষই হোক না কেন, তাকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন জঘন্য অপরাধ যারা করে, তারা কোনোভাবেই রেহাই পেতে পারে না। রাষ্ট্রকেও শুধু আন্দোলনের দিকে তাকিয়ে থেকে কিংবা আন্দোলন হলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধর্ষণ ঘটনায় গুরুত্ব দিতে না বলে সব ধর্ষণের দিকে সমান গুরুত্ব দিতে জোর নির্দেশ দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর ধর্ষণ ঘটনায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় গর্জে উঠলেও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির চা-বিক্রেতা স্বপন মামার প্রতিবন্ধী ছোট মেয়েটির ধর্ষণের বিচার চেয়ে কেউ আন্দোলন করেনি। সেই ধর্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু সেই আসামি জামিন পেয়েছেন এবং জামিনে বের হয়েই স্বপন মামা ও তাঁর কলেজপড়ুয়া ছেলের নামে করেছেন মাদকের মামলা। এ ধরনের নজির যাতে আর স্থাপিত হতে না পারে, তা রাষ্ট্রসহ সবাইকে দেখতে হবে। কেবল মধ্যবিত্ত কিংবা পরিচিতজন নয়, সব শ্রেণির নারী ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে এলাকায় এলাকায় রুখে দাঁড়ানো এখন খুবই দরকার।

ধর্ষকের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ দূর করতে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ধর্ষণকারীর ডিএনএ টেস্ট করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষের আস্থা যেমন ফিরে আসবে, তেমনি ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার বিচারপ্রক্রিয়াও দ্রুত হবে।

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান 

বিভাগের শিক্ষক

zobaidanasreen@gmail.com