ধর্মভিত্তিক দলে ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কাঁধে ভর করে ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনায় লিপ্ত। দলগুলোর তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আগ্রাসী ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়- ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধারক-বাহকরা তাদের পরীক্ষিত মিত্র বিএনপি ও জামায়াতকে বেছে নিয়েছে। এ মুহূর্তে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রাসী মনোভাব, সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড ও উচ্ছৃঙ্খলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তাই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের গতিবিধি কঠোর নজরদারির আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভূমিকায় বলা হয়- সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ১৯৮৯ সালের খেলাফত মজলিশ এবং ১৯৯০ সালের বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও ইসলামী ঐক্যজোটসহ বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল গঠিত হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাদের মাধ্যমে বিএনপি অরাজনৈতিক দল হেফাজতে ইসলামকে ম্যানেজ করে। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতকে দিয়ে বিএনপি সরকার পতনের অপচেষ্টা চালায়। তবে সরকারের দূরদর্শিতায় ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। তবে এখনও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্র থেমে নেই।

গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, প্রথম দিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে নিয়মিত বিবৃতি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাত। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুতে তারা স্বতন্ত্রভাবে কর্মসূচি পালন করত। ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি চারদলীয় জোট গঠন করে। তখন থেকে জামায়াত রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। বিএনপির সীমাহীন দুর্নীতি, জঙ্গিবাদের উত্থান ও জামায়াত প্রীতির কারণে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। সন্ত্রাসী দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ কারণে জামায়াত নির্ভর বিএনপি ক্রমান্বয়ে রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়- ১৯৮১ সালে মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ (হাফেজ্জি হুজুর) রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়ে কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইসলামপন্থিরা রাজনীতিতে শক্তি সঞ্চয় করে। জিয়া ও এরশাদের সময় রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য, সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান, রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার মাধ্যমে ইসলামি দলগুলো শক্তিশালী হয়েছে। পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসা প্রসারের কারণে মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামিপন্থি দলগুলো ভিত্তি ও শক্তিমত্তা জোরালো হয়। নির্বাচন ও রাজনীতির মাঠে সুবিধা লাভের জন্য বিএনপি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে।

গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ, ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার লোভে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ কারণে ধর্মভিত্তিক দলগুলো ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ধারণা, সাধারণ মানুষ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ধর্মভিত্তিক দলগুলো তাদের সঙ্গে থাকলে সাধারণ মানুষের সমর্থন ও রাজনীতির মাঠে সুবিধা লাভ করা যাবে। এ ধারণা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ব্যবহার করে। এ সুযোগে ধর্মভিত্তিক দলগুলো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে তারা সরকারবিরোধী বক্তৃতা-বিবৃতি ও কর্মসূচি পালন শুরু করে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলো সরকারবিরোধী ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ব্যবহার করছে ও প্রাধান্য দিচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৬৫টি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ ইসলামী পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ফরাজী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ইউনাইটেড পার্টি ইত্যাদি। এসব দলগুলো হাইকোর্টের প্রধান ফটক থেকে গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণ, ভারতে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনসহ নানা ইস্যুতে জোরালো কর্মসূচি পালন করে।

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়- যে কোনো অপতৎপরতা বন্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গতিবিধি কঠোর নজরদারির আওতায় আনা প্রয়োজন। সরকারবিরোধী ও স্বার্থবাদী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। হেফাজতে ইসলাম বর্তমানে রাজনীতির মাঠে একটি বড় ফ্যাক্টর। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলটিকে রাজনীতির মাঠে কেউ যাতে ব্যবহারের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে সজাগ থাকা জরুরি।

 

সুত্রঃ যুগান্তর