দ্রব্যমূল্যের এই চাপ সামলানো কঠিন

আমাদের বাসায় প্রতিদিন একজন দু’জন করে হলেও বুধবারে ভিক্ষুক আসে ঘটা করে। এককভাবে এবং গ্রুপে গ্রুপে সেদিন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন ভিক্ষুক আসে। আমার স্ত্রীই তাদের সামলান। গেল বুধবারও তাদের আগমনের ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো অর্থ বরাদ্দের দাবিতে। এতদিন ধরে জনপ্রতি পাঁচ টাকা করে দেওয়া হতো। গত বুধবারে মৃদু প্রতিবাদ হলো-‘টাকা ১০ খান করি দিতি হবি’। কেন? ‘কেন আবার, বাজারে তো যান না, গিয়া দেখেন সবকিছুতে আগুন।’ ভিক্ষুকরা জানেনই না যে, আমার এই সীমিত আয়ের সংসারে বাজারের কাজটি আমার স্ত্রীই করে থাকেন। অগত্যা দাবি মানতেই হলো। আজকের বাজারে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, তার খবর জানার জন্য আপনাকে বাজারে যেতে হবে না, ভুক্তভোগীরা এসে আপনার কানে দিয়ে যাবে।

গত সপ্তাহের খোলাবাজার পরিস্থিতি নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষদের চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে গত সপ্তাহে খোলাবাজারে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি ২ টাকা থেকে ৫ টাকা। খোদ সরকারি বিতরণকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক খুচরা বাজার পণ্যমূল্য তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, দুদিনের ব্যবধানে খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের দাম শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ, পাম অয়েলের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ ও পাম অয়েল সুপারের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ। তিন দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি চিনির মূল্য বেড়েছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে ১৬ শতাংশেরও বেশি। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হলো, বিশ্ববাজারে গত ১ বছরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশ এবং পাম অয়েলের ৭৬ শতাংশ। বিপরীতে বাংলাদেশে এ দুটি পণ্যের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৪৩ ও ৫৪ শতাংশ। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ, যার বিপরীতে বাংলাদেশে দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ। এটা উচ্চবিত্তের জন্য সান্ত্বনার বিষয় হতে পারে; কিন্তু নিম্ন, মধ্য, বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য মোটেই সুখকর নয়। তাদের আয় তো ১ শতাংশও বাড়েনি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানিনির্ভরতার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমাদের মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের পরও প্রায় ৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। মূলত ভারত, তারপর মিয়ানমার ও তুরস্ক থেকে এ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। আমরা যদি একটি বছরকে চার ভাগ করি, তাহলে প্রতি ভাগে তিন মাস পড়ে। গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। সে হিসাবে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার মতো কোনো কারণ ছিল না। আবার আমাদের দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২০ লাখ টন। সেখানে দেশীয়ভাবে উৎপাদন হয় মাত্র ২ লাখ টন। ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে আমদানি করা হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৪৮ হাজার টন, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। চিনির বেলাতে তা আরও কম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে দেশে বছরে ১৮ লাখ টন চিনির চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় মাত্র ৩০ হাজার টন। বাকি পুরোটাই আমদানি করতে হয়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এ তিন মাসে চিনি আদানি করা হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ২১৩ টন। অন্যদিকে মসুর ডালের চাহিদাও উৎপাদনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। দেশে মসুর ডালের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৫ লাখ টন। তার বিপরীতে দেশে উৎপাদিত হয় ২ লাখ ৫৮ হাজার টন। গত তিন মাসে আমদানি করা হয়েছে ৬২ হাজার টন। বছরওয়ারি হিসাবে ডালের আমদানি ঠিকই আছে।

বছরওয়ারি দাম বৃদ্ধি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা না বা তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, এই দাম বৃদ্ধির মাত্রা কতখানি। সরকারি তরফ থেকে বলা হয়, দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের কম। অর্থাৎ গেল বছরের ১০০ টাকার পণ্যের দাম এ বছর হবে ১০৬ টাকা। সে হিসাবে ৫ বছরে কোনো পণ্যের দাম ৩৩ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বেড়েছে অনেক বেশি। ২০১৬ সালে ৫ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল ছিল ৪৯০ টাকা। আজকে তা ৭২৫ টাকা। পাঁচ বছরে দাম বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। সরকারের মূল্যস্ফীতির হিসাবে মিনিকেট চালের দাম ঠিক আছে। ২০১৬ সালের ৫০ টাকার মিনিকেট এখন ৩৪ শতাংশ বেড়ে ৬৭ টাকা হয়েছে। তবে এ ৩৪ শতাংশও বাড়ার কথা নয়। কেননা বিগত বছরগুলোতে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। আমরা যে পেঁয়াজ ২০১৬ সালে খেয়েছি ৩৫ টাকায়, তা ২০২১ সালে কিনতে হচ্ছে ৭৫ টাকায়। দ্বিগুণেরও বেশি দাম বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪ শতাংশে। রুই মাছ ২০১৬ সালে ছিল ২২০ টাকা কেজি, যা এখন ৩৫০ টাকা কেজি। মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ৬০ শতাংশ। দেশি মুরগি খাওয়া সাধারণ মানুষের বরাত থেকে উঠে গেছে। ব্রয়লার মুরগিই সম্বল। ২০১৬ সালে সেই মুরগির দাম ছিল ১১০ টাকা কেজি। তার দামও ৫ বছরে প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৭৫ টাকা। সুতরাং মূল্যস্ফীতির সরকারি হার গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি হবে।

দুর্গতির সঙ্গেই এ দেশের মানুষের বসবাস, দুর্গতি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো এ দুর্গতির সময়সীমা। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির এ চাপ আরও বাড়বে বলে সতর্ক করেছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ ভূমিকা রাখার কথাও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চারটি ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো-বৈশ্বিক খাতে প্রত্যাশার চেয়ে পুনরুদ্ধারের গতি কম, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হারের ঊর্ধ্বগতি, শ্রমবাজারে কর্মের অভাব এবং পণ্য পরিবহণে খরচের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। সুতরাং মূল্যবৃদ্ধির চাপ থেকে সহসা মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

বাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখে চাহিদার বিপরীতে জোগান। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ আছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও বাজারে সরবরাহের সংকট তৈরি করা হয়। সে জন্য বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা আমাদের দেশেও আছে। প্রতিটি জেলার জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে বাজার মনিটরিং করা হয়। সেখানে যদি কোনো রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে তাহলে সুফল পাওয়া যাবে না। মানুষের কথা ভাবলে এ ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে।

কোনো ব্যবসায়ী ১০০ টাকার পণ্য আমদানি করে ৯০ টাকায় বিক্রি করবেন কি? অবশ্যই না। তবে আইন অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সে অনুযায়ী মূল্য সমন্বয় করতে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো ট্যারিফ কমিশনে চিঠি দেয়। এরপর পর্যালোচনা করে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় দেখা গেছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর সমন্বয় সভা চিনির খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে প্রতি কেজি ৭৪-৭৫ টাকা। কিন্তু টিসিবির পর্যবেক্ষণ বলছে, চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৯ থেকে ৮০ টাকায়। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্ধিত দামের পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করার আগে থেকেই দাম বাড়ানো হয়। বিপরীতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমানো হয় না। এ দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পর ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব থেকে সাধারণ ভোক্তাকে রেহাই দেওয়ার একটাই পথ, তা হলো আমদানি কর প্রত্যাহার করা। সাময়িক সমাধানের জন্য হলেও তা করতে হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন এক কেজি চিনিতে মোট কর দিতে হয় প্রায় ২৮ টাকা। আর এক লিটার সয়াবিন তেলে করের পরিমাণ ২০ টাকারও বেশি। আমাদের সাধারণ মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এ থেকে নিস্তার চাই।

সবশেষে বলতে চাই, কোনো দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন কিংবা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল লক্ষ্য হলো সে দেশের সাধারণ মানুষ। এ সাধারণ মানুষেরই উন্নয়নের ফল ভোগ করার কথা। কিন্তু কোনো উন্নয়ন যদি একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে ফাঁপিয়ে-ফুলিয়ে তোলে, তাহলে আক্ষেপের সুরে বলতেই হবে-‘বাপ বড়লোক বাপের ঝি, ভাই বড়লোক আমার কী’!

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

সূত্রঃ যুগান্তর