‘দেহ থাকতে পরিবারের কাউকে না খেয়ে মরতে দেব না’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বসে থাকলে তো আর খাবার মিলবে না। মা, ভাই-বোনের মুখে খাবার দিতে হলে রাস্তায় নামতেই হবে। তাই ভাঙা পা আর অসুস্থ শরীরেও আমাকে পত্রিকা হাতে ভার্সিটিতে আসতে হতো। জীবনে পরিশ্রম কি আমি তা ছোটবেলা থেকেই দেখতেছি।- কথাগুলো বলছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সকলের পরিচত মুখ সাকিব। পুরো নাম কোরবান আলী সাকিব।

 

সবাই সাকিব নামেই তাকে ডাকে। আপনজন বলতে আছে মা, বড় বোন আর ছোট এক ভাই। সাকিব পড়ালেখা করেছে একটা মাদ্রাসায় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত। গ্রামের বাড়ি রাজশাহী জেলার চরগা থানার রসুলপুর গ্রামে। খুব ছোটবেলায় সাকিব তার বাবাকে হারায়। চিকিৎসার অভাবে বাবা মারা যান। মাও বর্তমানে অসুস্থ।

 

একে তো অভাবের সংসারে জন্ম তার ওপর বাবা নেই। ফলে পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সাকিবের কাঁধে এসে পড়ে সংসারের দায়িত্ব। এলাকার অন্য ছেলেরা যখন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত সাকিবকে তখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হতো কাজের সন্ধানে। কোনো পথ না পেয়ে মাত্র ৭ বছর বয়সেই গাড়ির হেল্পারির মধ্য দিয়ে শুরু তার কর্মজীবন। সেখানকার সামান্য উপার্জন তার পরিবারে ব্যয় বহনে পর্যাপ্ত ছিল না। তাই এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে কাজ নেন পত্রিকা বিক্রির। শুরুতে মানুষের বাসায় গিয়ে পত্রিকা দিয়ে আসতো সাকিব।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা প্রসঙ্গে সাকিব বলে, ‘একদিন ষোলোশহরে ট্রেনে অনেক লোক দেখে এক দোকানদারের কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। ভার্সিটিতে অনেক মানুষ পড়ালেখা করে। তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও সেখানে যাবো।’

 

বাসায় পত্রিকা দেয়ার কাজ ছেড়ে দিয়ে ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পত্রিকা নিয়ে আসতে শুরু করে সাকিব। একদিকে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা অন্যদিকে বড় বোনের বিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা সব সময় তাকে নাড়া দেয়। ছোট ভাই রহমত রানা পড়ছে স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে। ভাইয়ের পড়ার খরচও দিতে হচ্ছে তাকে। সাকিব একবার কিছু টাকা জমিয়েছিল বোনের বিয়ের জন্য। কিন্তু মায়ের অসুস্থতায় বোনের বিয়ে দেয়া আর হয়ে ওঠেনি।

 

চলতি বছরের রমজান মাসের পরেই ঘটে তার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। চৌধুরী হাটের স্টেশনে ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে প্রায় একমাস তার পত্রিকা বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। আয় না থাকায় পরিবারের খরচ মেটাতেও সমস্যা হচ্ছিল দেখে আবার বেরিয়ে পরে সেই খোড়া পা নিয়ে। তার এই করুণ অবস্থা দেখে চবির কিছু শিক্ষার্থী এবং প্রক্টর কিছু টাকা তুলে দেন। সে এই টাকাগুলো নিজের চিকিৎসার জন্য ব্যয় না করে ৭ হাজার টাকা দিয়ে মায়ের জন্য একটা হুইল চেয়ার কেনে।

 

বর্তমান জীবন আর ভবিষ্যত প্রসঙ্গে সাকিব বলে, ‘আমার এখন একটাই চাওয়া, তা হলো ছোট ভাইকে মানুষের মতো মানুষ করব আর বোনের বিয়েটা যত দ্রুত সম্ভব দেয়ার চেষ্টা করব। আর মোটামুটি এখন ভালোই আছি মা, ভাই আর বোনকে নিয়ে। জীবনে যত কষ্টই হোক আমার এই দেহ থাকতে আমার পরিবারের কাউকে না খেয়ে মরতে দেব না।’

 

চবির কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় সাকিবকে নিয়ে। তারা বলেন, সাকিব সবার সঙ্গে খুবই সুন্দর এবং সাবলীল ভাষায় কথা বলে। ক্যাম্পাসের সবাই এই সৎ এবং সাহসী কাজের জন্য তাকে অনেক স্নেহ করে। শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও এভাবেই এগিয়ে চলেছে সাকিবদের জীবন। সমাজের বিত্তবানদের একটু সহায়তা পেলে এরাও হতে পারে দেশের যোগ্য নাগরিক।

সূত্র:রাইজিংবিডি