দেশে ‘ভিআইপি’ মাদক আইস’র সিন্ডিকেট

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

 

‘ভিআইপি’ মাদক বলে পরিচিত আইসের ব্যবসায় দেশে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মালয়েশিয়ায় বসে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এ সিণ্ডিকেট। এ তথ্য পেয়ে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা সিন্ডিকেটে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে। মালয়েশিয়ায় বসে বাংলাদেশি ওই ব্যক্তি দেশে ভয়ঙ্কর মাদক ‘আইস’ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে কৌশলে দেশে আইস পাঠাচ্ছেন। বাহক হিসেবে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রবাস ফেরত মানুষকে। আর দেশের এজেন্টরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অভিজাত শ্রেণির ক্রেতার কাছে সরবরাহ করছে আইস। ক্রেতারা আবার পরিচিতদের মধ্যে সরবরাহ করছে।

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ায় বসে যিনি দেশে আইস ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন তিনি একজন ব্যবসায়ী। আমদানি রপ্তানির ব্যবসা করেন। মোবাইল ফোন, কম্বলসহ বিভিন্ন পণ্য দেশে পাঠান। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে আইস কারবার করেন। ঢাকায় আইস কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে চন্দন রায়  নামে একজনকে গ্রেপ্তারের পর এই ব্যবসায়ীর তথ্য পাওয়া যায়।

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, ৪ঠা নভেম্বর আইসের একটি চালানসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে চন্দন রায় নামের একজন সোনা ব্যবসায়ী ছিলেন।  চন্দন রায় মূলত বিদেশ থেকে বৈধভাবে সোনা এনে ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু বছরখানেক ধরে মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে আইস কারবারে জড়িয়ে পড়েন। প্রথম দিকে তার নিজেরও আইস সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।  বাংলাদেশি ওই ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তারের পর সোনা ব্যবসায়ী চন্দন রায় এই ব্যবসায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে চন্দন জানিয়েছেন, বছরখানেক ধরে মালয়েশিয়া থেকে তিনি আইস নিয়ে আসছেন। মালয়েশিয়ার ওই ব্যবসায়ীই তার কাছে আইস পাঠান। সিলিকা জেলের আড়ালে আইস বাংলাদেশে আনা হয়। মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় আসা যাত্রীদের বিভিন্ন উপহার দিয়ে আইস বহন করানো হয়। যারা বহন করে তারা জানে না তাদের দিয়ে আইসের চালান বহন করানো হয়। কারণ কম্বল বা অন্য পণ্যের ভেতরে ভালো করে পেঁচিয়ে আইসের চালান পাঠানো হয়। এতে করে বোঝার কোনো উপায় থাকে না। আইস অনেকটা সিলিকা জেল সদৃশ। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষও এই মাদক সম্পর্কে অবগত না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলা হয় সোনা তৈরির কেমিক্যাল।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে যারা আইস সেবন করে তারা আলট্রা রিচ। নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীরাই এর মূল ক্রেতা। ব্যয়বহুল মাদক আইস সবার পক্ষে সেবন করা সহজ নয়। ক্ষুদ্র দানাদার আইস দিয়ে একবার নেশা করতে অনেক টাকা লাগে। ঢাকায় যারা আইস সেবন করে তারা এক সময় দেশের বাইরে এটি সেবন করেছে। মালয়েশিয়া, হংকং, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড, আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশে এটি পাওয়া যায়। তবে একটি সিন্ডিকেট বাংলাদেশকে টার্গেট করে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খোদ বাংলাদেশি কয়েকজন কারবারি এটি দেশে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।

ডিবি জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক একটি চক্র বাংলাদেশিদের মাধ্যমে আইসের একটি চাঙ্গা বাজার তৈরি করার চেষ্টা করছে। চন্দন রায়ের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত ঢাকায় শতাধিক ক্রেতার সন্ধান মিলেছে। যারা নিয়মিত-অনিয়মিত আইস সেবনের সঙ্গে জড়িত। বিত্তশালী পরিবারের এসব সদস্যের কাছে বিভিন্ন সময় চন্দন রায় আইস পৌঁছে দিতো। চন্দন রায় নিজে আইস ব্যবসা করতো আবার সেবনও করতো।
গত বছর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আইস কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে এক নাইজেরিয়ানকে গ্রেপ্তার করেছিল। আনাইচুকা নামের ওই নাইজেরিয়ানের কাছ থেকে ৫২২ গ্রাম আইস জব্দ করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর আনাইচুকা জানিয়েছিল, অল্প সময়ে ধনী হতে সে এই মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়। বাংলাদেশ ছাড়া আরো বিভিন্ন দেশে আইস ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন। উগান্ডা থেকে বিশেষ কৌশলে তার কাছে আইস পাঠানো হতো। এর আগে ওই বছরই ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী রাকিব উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ওই সময় তার বাসায় ইয়াবার সঙ্গে আইস পাওয়া যায়। তখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দারা আইস নিয়ে কাজ শুরু করেন। পরে তারা জানতে পারেন এই মাদক কারবারের মূল হোতা ঝিগাতলার ইঞ্জিনিয়ার রাশিদুজ্জামানের ছেলে হাসিব মোহাম্মদ রশিদ (৩২)। ঝিগাতলার ৭/এ’র ৬২ নম্বর সড়কে অভিযান চালিয়ে বাড়ির বেইজমেন্টে আইস তৈরির কারখানা পাওয়া যায়। সেখানে ছিল আইস ও এমডিএমএসহ সিউডোএফ্রিড্রিন এক্সটাকশন সুবিধা সংবলিত ডিস্টিলেশন চেম্বার। হাসিব পলাতক থাকায় তাকে ওই সময় গ্রেপ্তার করা যায়নি। পরে মিরপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আইস বা আইস পিল দেশে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য মাদকের তুলনায় অনেকটাই নতুন মাদক। আইসের কেমিক্যালের নাম মেথান ফিটামিন। এটির উৎপত্তিস্থল অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন। ১০ গ্রাম আইস বাংলাদেশে বিক্রি হয় ১ লাখ টাকায়। আইস সেবনের পর ইয়াবার চেয়ে ১০০ গুন বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এটি মূলত স্নায়ু উত্তেজক মাদক। যা সেবনের ফলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় হরমোনের উত্তেজনা হাজার গুণ বেড়ে যায়। এর ফলে ব্রেন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটির তীব্র রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ধীরে ধীরে দাঁতও ক্ষয়ে যায়। এই মাদক সেবনে স্থায়ী হ্যাসুলিনেশন সৃষ্টি হয়। কাচের পাইপ দিয়ে তৈরি বিশেষ পাত্র বঙ দিয়ে ধূমপানের মতো করে আইস সেবন করা হয়।

মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) সহকারী পুলিশ কমিশনার জাবেদ ইকবাল মানবজমিনকে বলেন, আইস যারা সেবন করে তারা অভিজাত শ্রেণির। শুধু আইস ব্যবসায়ী নয় যারা সেবন করছে তাদেরকেও আমরা নজরদারিতে রেখেছি। এখন পর্যন্ত এমন শতাধিক ব্যক্তির তালিকা আমরা পেয়েছি। এছাড়া আইস কারবারের সঙ্গে জড়িত আছে এমন ব্যক্তিদেরও আমরা খোঁজ করছি। যদি আর কেউ জড়িত থাকে তবে আমরা তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ী বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে আইস দেশে পাঠান। গ্রেপ্তার চন্দন রায় সেগুলো নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছে বিক্রি করতেন। ব্যয়বহুল এই মাদক চন্দন রায় প্রতি ১০ গ্রাম বিক্রি করতেন ১ লাখ টাকায়। যারা কিনতো তারা হয়তো আরো বেশি দামে বিক্রি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীরা আইসের ক্রেতা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত পরিচালক মোসাদ্দেক হোসেন রেজা মানবজমিনকে বলেন, আইস অভিজাত শ্রেণির মাদক। এটি আমাদের দেশে তৈরি হয় না। অন্য মাদক কারবারিদের বিষয়ে আমরা যে ধরনের পদক্ষেপ নেই আইস কারবারিদের বিষয়ে আমাদের পদক্ষেপ একই। আইসের ওপরে আমাদের নজরদারি আছে। গোপনে যারা এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।

 

সূত্র: মানবজমিন