দেশীয় সংস্কৃতির জাগরণ দরকার

উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে জলে-জঙ্গলে, উঠানে সর্বস্থানে নানা রকমের গল্প এবং খুনসুটির আচরণ দেখা যায়। তবে সময়ের করাল স্রোতে এই রকমারি গল্পের আড়ালে কেউ কেউ বদনাম, কুৎসা এবং অনিষ্টসম্পন্ন গল্পও আঁটেন, ছড়ান। কেউ কেউ একে সমালোচনা এবং বিশ্লেষণের মুখোশ পরাতে চাইলেও আসলে যে এটা পরনিন্দাচর্চা সেটা বুঝতে চান না। বৈশ্বিক কাঠামোয় যেখানে সমালোচনা, বিশ্লেষণ করতে দীর্ঘ সাধনা, নিরীক্ষণ এবং পড়াশোনা প্রয়োজন, সেখানে এখানে পথে-ঘাটে, চায়ের দোকানে এমনকি মুখে মুখেও এসব ঘটে যায়!

মজার বিষয় হলো, এই অংশটি নিজেদের অযাচিত ও মতলববাজ চিন্তাকে জায়েজ করতে বাকস্বাধীনতার মুখোশও পরে ফেলেন। আবার কিছু আছেন যাঁরা কোনটি সাধারণের আলাপন, গল্প এটা না বুঝেই মাঝখান থেকে একটা তর্ক জুড়ে দেন, যা শিক্ষার অভাবের যথার্থতা প্রকাশ করে। এই শিক্ষার শূন্যতা দূর করতে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দেশের সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রমঞ্চ দেশের শিল্পকলা একাডেমিগুলোর প্রচার, প্রসার ও বহুদার্থবোধকতা প্রয়োজন।

এই ‘প্রয়োজন’ শব্দটির বিশেষ অনুসন্ধান করা আবশ্যক। কারণ সামাজিক কাঠামো বিবেচনায় স্পষ্ট, এখানে যার যা প্রয়োজন সে সেটাই অঙ্গে জড়ায়, লালন করে। সে হিসেবে দেখা যায়, একজন দুর্নীতিপরায়ণ কিংবা আঙুল ফুলে কলাগাছসম্পন্ন ব্যক্তি ঢাকায় দুদকের কার্যালয় চিনলেও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি চেনেন না। অবশ্য এটা সেই ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিকতাই। কারণ লুটের টাকার হিসেবে অস্থির সত্তা আর যা-ই হোক, সুস্থ সংস্কৃতির পবিত্রতায় শুদ্ধ হয় না। তবে এও সত্য, সেই ব্যক্তির সাংস্কৃতিক শিক্ষা থাকলে তিনি দুর্নীতিই করতে পারতেন না।

দেশের সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র ঢাকার শিল্পকলাকেন্দ্রিক যাতায়াতের কথা উঠলেই একটা বৃহৎ অংশ সময়ের টানাপড়েনকে অজুহাত হিসেবে সামনে আনেন। অথচ শিল্পকলাকেন্দ্রিক বিনোদনের যে খরচা তা খুবই সীমিত। ৫০ থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে এখানে বিনোদিত হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এর পরও এখানে ব্যাপকসংখ্যক দর্শক আসছেন না। বরং দর্শক হিসেবে যাঁরা আসছেন তাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের আত্মীয় কিংবা পরিচিতজন।

কেন এই দর্শক উদাসীনতা, এই বিষয়টিকে আলোচনায় আনলে সহজ অর্থে একটি যুক্তি সামনে আসে। আর তা হলো, এত দীর্ঘ জ্যাম পেরিয়ে শিল্পকলায় গিয়ে বিনোদিত হতে চাওয়া ভীষণ সময়সাপেক্ষ। কেউ কেউ এমনও মত প্রকাশ করেন যে একদিন শিল্পকলার উদ্দেশে যাত্রা মানে গোটা দিন এক জায়গায়, একক কারণে চলে যাওয়া। এটাই আসলে কারণ। কারণ নগরায়ণের এই স্রোতে মানুষ স্বল্প সময়ে বহু ব্যঞ্জনা চায়।

অর্থাৎ সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে গেলে যেমন একই সঙ্গে কেনাকাটা, খাবার, বসার ও চলার জায়গা পায় সেসবের বহু ব্যঞ্জনা এখানেও চায়। আর এমনটা চাওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তিও আছে। সপ্তাহের ছুটির দিন একটি। কাজেই এই এক দিবসে মানুষ রকমারি আয়োজন চাইবে—এটাই স্বাভাবিক।

পৃথিবীর সব সৃষ্টি মানুষকে কেন্দ্র করে, মানুষের জন্য। কাজেই যেখানে মানুষ সরাসরি পারফরম করছেন, সেই প্রযোজনা মানুষের কাছে জনপ্রিয় হবে না, এটা ভাবা বা মানা অসংগতিসম্পন্ন। এ ক্ষেত্রে শিল্পকলাকেন্দ্রিক মানসম্পন্ন প্রযোজনার সংখ্যা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি এখানে এসে মানুষ যেন খাবারের স্বল্পতায় না ভোগে, সেই বিবেচনাও জরুরি। এর বাইরে সপ্তাহে একটি করে দেশীয় পণ্যের মেলা করা প্রয়োজন। যার প্রচার এবং প্রসার হবে সর্বব্যাপী।

এসব করতে পারলে দেশীয় সংস্কৃতিকে আগলে ও আঁকড়ে ধরা মানুষগুলো পাদপ্রদীপে আসার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির যে বৈচিত্র্য ও ব্যঞ্জনা তাও বৈশ্বিক আঙিনায় আলো ছড়াবে। তবে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির আউল, বাউল, বাদক এবং সাধকদের প্রতি। আরো স্পষ্ট করে বললে, শিল্পকলার দালান কাঠামো কিংবা ফাইলপত্রকেন্দ্রিক যে বিনিয়োগ তার চেয়ে প্রবল এবং নীরবে এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। কারণ বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে সমাগম, মেলা এবং আয়োজন সব কিছু পুরোপুরি বন্ধ ছিল।

এ বিষয়গুলো যদি কেউ তাচ্ছিল্য কিংবা উপেক্ষা করেন—তাঁদের মনে রাখা উচিত, প্রবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধসম্পন্ন জাতি, দেশও তাসের দেশের মতো ধসে পড়েছে, শুধু দেশীয় সংস্কৃতির জাগরণ ও যত্ন না নেওয়ায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
raburabaya1993@gmail.com

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ