দেউলিয়ার পথে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দেউলিয়ার পথে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) নামে আরও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর বিতরণ করা ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৬ শতাংশই কুঋণ। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশই নামে-বেনামে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের নেতা মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন সামম্যান গ্রুপের কাছে। টাকার অঙ্কে তার কাছে পাওনা প্রায় হাজার কোটি টাকা। এসব টাকা আদায়ে তার বিরুদ্ধেই ৩০টি মামলা হয়েছে। সবকিছু মিলে প্রতিষ্ঠানটি এখন নামেই বেঁচে আছে।

এর আগে দেনার দায়ে পিপলস লিজিং নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ জালিয়াতির কারণে ২০১৬ সালে বিআইএফসি’র পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০১৭ সালেই প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন করতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো অদৃশ্য কারণে সেটি আটকে যায়। বর্তমানে এটি আর্থিক খাতের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে এই প্রতিষ্ঠানে বেশি ক্ষতি হয়েছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের। ১০ টাকার শেয়ার এখন ২ টাকায় নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে দ্রুত অবসায়ন করা উচিত।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই কোম্পানি অবসায়নই একমাত্র পথ। অবসায়নের মাধ্যমে সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহককে টাকা দিতে হবে। আর ওই পরিমাণ সম্পদ না থাকলে গ্রাহকের ক্ষতি হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

বর্তমান চেয়ারম্যান রুহুল আমিন রোববার বলেন, কোম্পানি ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর প্রায় পুরোটাই খেলাপি। এসব ঋণ আদায়ের জন্য প্রায় ৩০০ মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঋণ ১ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ আদায়ের জন্য তার নামে ৩০টির মতো মামলা করা হয়েছে। সমস্যা হল, মামলা করার পর তিনি উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। এই আদেশ বাতিল করাতে আমাদের তিন মাসের মতো সময় লাগে।

এ ছাড়াও কোনো কোনো মামলায় তিনি দুই-তিন তারিখ হাজির হন না। এতে অনেক সময় চলে যায়। রুহুল আমিন আরও বলেন, আমাদের কাছে গ্রাহকের আমানত রয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের লিজ ফাইন্যান্স ৬০০ কোটি এবং ক্ষুদ্র গ্রাহকের ২০০ কোটি টাকা। অনেক আগে আমরা চিঠি দিয়ে বলেছি, ব্যাংকের টাকা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ কিছু টাকা আদায় হলে সেটি দিয়ে ক্ষুদ্র গ্রাহকের দায় মেটানো হচ্ছে। তার মতে, সবার আগে বিআইএফসি অবসায়নের কথা ছিল। কিন্তু কোনো কারণে সেটি হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রতিষ্ঠানটির অনিয়মে মেজর (অব.) মান্নান ও তার পরিবারের বড় ধরনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে মান্নান ও তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান পরিদর্শনে উদ্ঘাটিত অনিয়মের দায়ভার স্বীকার করেন।

এ সময় তারা ঋণের আড়ালে উত্তোলিত অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পালন করেননি। ৪৮টি ঋণের আড়ালে পুঞ্জীভূত ৭০৩ কোটি টাকা সানম্যান ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশনের নামে স্থানান্তরপূর্বক ২০১৫ সালে পুনঃতফসিলের আবেদন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা নাকচ করে দেয়। অনিয়ম উদ্ঘাটনের পর মেজর (অব.) মান্নান পাঁচ কিস্তিতে ১১৯ কোটি ৮৩ লাখ পরিশোধ করেন। বাকি অর্থ পরিশোধের ব্যাপারে তাগাদা দেয়া হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এছাড়া টাকা পরিশোধের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পালন করেননি তিনি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে মামলা করে বিআইএফসি। কিন্তু হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে আইনি প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ ও ঋণের টাকা যথাযথ কাজে ব্যবহার না করে অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ কারণে প্রতারণা, জালিয়াতি ও অর্থ পাচার আইনে মেজর (অব.) মান্নানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২ আগস্ট মতিঝিল থানায় মামলা করে সিআইডি। যার নম্বর ৪। এর আগে বিআইএফসিতে মেজর মান্নান ও তার পরিবারের অনিয়মের তথ্য পাওয়ায় বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর সিআইডি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষের মধ্যেও চরম দ্বন্দ্ব রয়েছে। সাবেক জেলা জজ ইখতেজার আহমেদকে চেয়ারম্যান করে গত বছরের জুনে নতুন পর্ষদ গঠন করে মেজর (অব.) মান্নানের গ্রুপ। কিন্তু ওই পর্ষদের অনুমোদন দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানতে চাইলে মেজর (অব.) আবদুল মান্নান রোববার বলেন, যে অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, তা সব চক্রান্তের অংশ। বর্তমানে যারা পর্ষদে আছেন, তারা কোম্পানির ধ্বংসের জন্য এসব বদনাম ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আমি ঋণ নিইনি। ঋণের গ্যারান্টার। ফলে আমার বিরুদ্ধে নয়, গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে এসব মামলা শিগগিরই ভ্যাকেট হয়ে যাবে। তিনি বলেন, যেসব ঋণ রয়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নিয়মে ২ শতাংশ সুদে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল হবে।

জানতে চাইলে মেজর মান্নানের গ্রুপে থাকা কোম্পানির পর্ষদের সদস্য প্রফেসর ফারুক খান বলেন, মান্নানের নামে কোনো মামলা নেই। তিনি ৪০ ঋণগৃহীতার দায়িত্ব নিয়েছেন। ওইসব গ্রাহকের নামে মামলা করা হয়েছে। ফলে মান্নানের ওপর দায় আসছে। তিনি বলেন, বর্তমান পর্ষদের দায়িত্ব পালনের বৈধতা নেই। কারণ তারা মাত্র ৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। যে কারণে তারা কোম্পানিকে ওউন করেন না। তিনি আরও বলেন, মামলা করে গ্রাহকের আদায়কে দীর্ঘসূত্রতায় ফেলে দেয়া হল। বিকল্প পথ হিসেবে গ্রাহককে প্রেসারে টাকা আদায় করা যেত।

২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরের শেয়ারে বিনিয়োগের কারণে কোম্পানিটির নিট লোকসানের পরিমাণ ২০ কোটি ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫১ টাকা। তাছাড়া সম্পদ পুনঃমূল্যায়ন রিজার্ভের ওপর কোম্পানিটি তার ডেফার্ড ট্যাক্স ৪০ কোটি ৩৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৬৭ টাকা পরিশোধ করেনি। নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানির মোট বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ (ঋণ, লিজ এবং অগ্রিম) ৮৪১ কোটি ৪৮ লাখ ২১ হাজার ৭৫৭ টাকার মধ্যে সানম্যান গ্রুপের কাছে ৬৩৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ।

তবে সুদসহ বর্তমানে ওই ঋণ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এই ঋণ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এদিকে বিশ্বাস গ্রুপের কাছে কোম্পানিটির ২০ কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৮ টাকা ঋণও রয়েছে হুমকির মুখে, যা মোট ঋণের ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে ১ দশমিক ৩০ শতাংশ চলতি বছরে আদায় করা সম্ভব। এ ঋণ আইন অনুযায়ী আদায়ের চেষ্টা চলছে।

বিআইএফসি ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির মোট পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৭৬৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ সালের সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। আলোচ্য সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১৩ টাকা ৫ পয়সা। শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ৭৯ টাকা ৪৫ পয়সা (নেতিবাচক)।

২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১ টাকা ৭১ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে লোকসান ছিল ১ টাকা ৯২ পয়সা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ শেষে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ৮১ টাকা ১৬ পয়সা (নেতিবাচক)। কোম্পানির মোট শেয়ারের উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৩৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৮ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ রয়েছে।