দুর্লভ বৃক্ষরোপণ ও জোছনাযাপন অনুষ্ঠান উপলক্ষে পথনাট্য

নিজস্ব প্রতিবেদক:

হেমন্তের সন্ধ্যায় ঘাসের ডগার শিশির বিন্দু জমেছে। হিমেল হাওয়া বইছে। বন্ধুরা মিলে হাঁটছিলাম ক্যাম্পাসের বদ্ধভূমির রাস্তায়। হুট করে কানে ভেসে আসলো, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ফল নয়, বরং ফলিত হওয়া। সৃজনশীল ও গ্রেডিং পদ্ধতিতে যেনো প্রকৃত শিক্ষা হারিয়ে না যায়।’ তারপর কাছে গিয়ে দেখলাম একটা পথনাট্য চলছে। বঙ্গবন্ধুর স্মরণপথ ‘তিষ্ঠ ক্ষণকালের’ উদ্বোধন উপলক্ষে দুলর্ভ বৃক্ষরোপণ ও জোছনাযাপন অনুষ্ঠানে অন্তর্বতী ভাবনায় ‘বিফলে মূল্য ফেরৎ’ নামের এই পথনাট্য পরিবেশন হয়। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা নিয়ে ব্যাঙ্গাতকধর্মী এই পথনাটক গতকাল মঙ্গলবার (০৮ নভেম্বর) রাতে শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম ইন্টারন্যাশনাল ডরমিটরির মাঠে পরিবেশিত হয়।

পথনাট্যের শুরুর দৃশ্যে দেখা যায়, ‘হঠাৎ বিদ্যালয়ে একজন প্রাক্তন ছাত্র (বোধদ্বয়) ফিরে আসে। সেখানের পড়াশোনা তার বাস্তব জীবনে কোনো কাজে আসেনি বলে অভিযোগ তুলেন এবং সব ধরনের টিউশন ফি’র টাকা ফেরত চান। এটি শুনে স্কুলের প্রধান শিক্ষক চমকে যান। তাকে বলে সকল শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করার পর বিষয়টি জানাবে কিন্তু ছাত্র তার টাকা ফেরৎ না নিয়ে যাবে না বলে ঘোষণা করে। এবার স্কুলের প্রধান অন্যান্য শিক্ষকদের ডেকে সভা করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় তার একটা পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে যদি সে পাশ করে তাহলে টাকা ফেরত দেওয়া হবে না কারণ তিনি কিছু শিখেছেন। এই সিদ্ধান্তে ছাত্র রাজি হয়। পরবর্তীতে পরীক্ষা শুরু হলে বেশ সহজ সহজ প্রশ্ন করা হয় যাতে তিনি উত্তর দিতে পারেন। কিন্তু সহজ প্রশ্নের উত্তর তিনি খুবই ভিন্ন ও বাজে ভাবে দিচ্ছিলেন।

স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ পরীক্ষার সময় মোট পাঁচজন শিক্ষক ও বোধদ্বয় (ছাত্র) ছিলেন। প্রথমেই ইতিহাসের শিক্ষক প্রশ্ন করেন যে, ৩০ বছরের যুদ্ধ আসলে কত বছর ধরে চলেছিলো?

বোধদ্বয় উত্তর দেয় ৭ মিটার। তিনি আসলে ইচ্ছে করেই ভুল উত্তর দেন। তবে ইতিহাসের শিক্ষক এই উত্তরকে সম্পূর্ণ সঠিক বলে মেনে নেন। উত্তর হিসেবে সঠিক না মানলে তার টিউশনির সব টাকা ফেরত দিতে হবে। উত্তরের সাপেক্ষে শিক্ষক যুক্তি দেন যে, ‘যুদ্ধ ৩০ বছর হলেও গোলাবারুদ নিয়ে আসা, সৈন্যদের ঘুম, খাওয়াসহ নানা কাজে মোট ৭ বছর যুদ্ধ হয়। আর এই সময়কে আইন্সটাইনের থিউরিতে ফেললে সেটি হবে ৭ মিটার তাই উত্তর সম্পূর্ণ সঠিক।

গণিতের শিক্ষক এবার প্রশ্ন করে, আসলে তার মোট টিউশন ফি কত?
এবার উচ্ছ্বাস নিয়ে বোধদয় বলে, এসব প্রশ্নের উত্তর না পারলেও এই হিসেব আমি খুব ভালো করে বলতে পারবো। কারণ প্রতি বছর উন্নয়ন ফি, পরীক্ষার ফিসহ যত ফি দিয়েছি সব মনে আছে। গত ১১ বছরে আমি মোট ২ হাজার ৯শ ৩৬ টাকা ফি দিয়েছি।

এবার শিক্ষক চিৎকার করে বলে, এইত সঠিক, একদম সঠিক উত্তর হয়েছে। বোধদ্বয় তুমি অনেক কিছু শিখেছো। তাছাড়া এত দীর্ঘ হিসেব পারতে না। তাই তুমি টিউশন ফি পাবে না। স্কুল থেকে বেরিয়ে যাও।

করুণ সুর ভেসে উঠলো বোধদ্বয় যে তার শিক্ষকদের নাস্তানাবুদ করতে এসে নিজেই তেমন হয়ে গেছে। তবে যাবার সময় বলে, আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি শুধু আপনাদের শিক্ষায় সমৃদ্ধ হতে চেয়েছিলাম। আর ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসা শিক্ষার্থীও যেনো আপনাদের কাছ থেকে সব কিছু সমানভাবে পান সেটি চেয়েছিলা। আসলে শিক্ষার কাজ ফল চাওয়া নয়, বরং ফলিত হওয়া। আর সৃজনশীল ও গ্রেডিং সিস্টেমের মধ্যে যেনো প্রকৃত শিক্ষা না হারিয়ে যায়। এটিই আমার একমাত্র চাওয়া।

এসব কথা শোনার পর সব শিক্ষকের মাঝেই এক ধরনের আত্মপোলব্ধি হয়। তারাও বোধদ্বয়ের সঙ্গে মিলিত হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলে উঠে বোধদ্বয় তুমি আমাদের বোধ জাগ্রত করলে। আমাদের পুনজন্ম হলো।

এছাড়া অনুষ্ঠার শুরুর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুজিত সরকারের আত্মার শান্তি কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ স্মরণে শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম ইন্টারন্যাশনাল ডরমিটরির অভ্যন্তরে একটি স্মরণ পথের উদ্বোধন করা হয়। পথের দুই ধারে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ধারাবাহিক আখ্যান, বাণী ও স্থিরচিত্র স্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তীতে মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর স্মরণে ও মীর আব্দুল কাইয়ূম ২৫ নভেম্বর শহীদ হওয়ার দিবস বিবেচনায় ২৫টি দুলর্ভ প্রজাতির ৫০টি বৃক্ষরোপন করা হয়।

নাটক শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘জোৎস্না রাতে এমন আয়োজন চমৎকার। আমাদের প্রতিটি নাটক বা প্রদর্শনীতে নানা অভিযোগের দৃশ্য দেখানো হয়। কিন্তু এই পথনাট্যে কাউকে অভিযুক্ত বা কোনো অভিযোগ না করে একটি ঘটনাকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক এই ডরমিটরিতে অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী আছে, যাদের আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জানানো প্রয়োজন। এমন অনুষ্ঠানের মধ্যে একে অপরের মধ্যে সংস্কৃতির বিনিময় হবে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ূম ইন্টারন্যাশনাল ডরমিটরির ওয়ার্ডেন ও নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমানের নির্দেশনায় অভিনয় করেছেন আজমল মিঠু, তুহিন ইমরুল, পার্থ প্রতীম দে, রনি শীল, লিমন বিশ্বাস, গোলাম কিবরিয়া, ফাহমিদা পালি ও রুপন্তী রয়েল প্রমুখ।

এই অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম ও অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, বিশিষ্ট নাট্যজন মলয় ভৌমিকসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।