দুর্নীতির মহাআখড়া রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক :
পরিকল্পিত উন্নয়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালের রাজশাহী শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) প্রতিষ্ঠিত হয়। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী নগর উন্নয়ন, নগরীর পরিধি বৃদ্ধি আরডিএ’র প্রধান কাজ। এরইমধ্যে আরডিএ প্রতিষ্ঠার কেটে গেছে প্রায় ৪৭ বছর। দীর্ঘ সময়েও এই প্রতিষ্ঠান যে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।

*৪৭ বছরেও নেই আরডিএ’র নিজস্ব প্রকল্প

*পুরাতনকেই ভেঙ্গে সংস্কারের নামে টাকা হরিলুট

*সরকারী প্রকল্পে পকেট ভরছেন কর্মকর্তারা

*অনিয়মের কারণে প্রকল্প পরিচালক হয়েছেন লাঞ্ছিত

নগর পরিকল্পনায় আরডিএ’র বিশেষ ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অথচ অনেক পরে ১৯৮৭ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হলেও মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সফলতার পরিচয় দিয়েছে। রাসিকের জন্য আজ রাজশাহী নগরী বিশে^র দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর আরডিএ কর্তৃপক্ষ মহা দুর্নীতির কবলে মাথা নুইয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আরডিএ’র দুর্নীতির খবর স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ হলেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি।

জানা গেছে, অদ্যবধি পর্যন্ত আরডিএ কর্তৃপক্ষ রাজশাহীতে দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন করতে পারেনি। গুটি কয়েক রাস্তা-ঘাট, চলমান দুএকটি প্রকল্প ছাড়া রাজশাহীর উন্নয়নে আরডিএ’র কোনো অবদান নেই। বিশেষ করে আরডিএ কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত যে কাজগুলো করেছে সেই কাজগুলো আগেও ছিল, শুধু মাত্র সেটি সংস্কার করে দায়িত্ব সেরেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত আরডিএ কর্তৃপক্ষ প্লট বাণিজ্য ছাড়া নিজস্ব অর্থয়ানে কোনো কাজও করতে পারেনি।

তারপরও আরডিএ কর্তৃপক্ষ যে উন্নয়ন কাজ করেছে তার বেশিরভাগেরই দাবিদার রাসিক। নগরবাসীর প্রশ্ন, আরডিএ’র কাজ কি? শুধুই কি এনওসি আর প্ল্যান পাস করা? সেখানেও গ্রাহক সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন। নাকি প্রতি বছর নবায়ন করে গুটি কয়েক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারির পকেট ভর্তি করা?

অনুসন্ধানে জানা যায়, আরডিএ কর্তৃপক্ষ উন্নয়ন করতে না পারলেও যেকটি প্রকল্প সরকার দিয়েছে সেটি নিয়ে মেতে উঠেছে দুর্নীতির মহোৎসবে। গুটি কয়েক যে উন্নয়ন কাজ করেছে তার বেশিরভাগই প্রশ্ন বিদ্ধ। শুধু প্রকল্প নয়, আরডিএতে যারা কর্মরত তাদের চাকরিও প্রশ্ন বিদ্ধ। সরকারের বৈধ প্রকল্প আরডিএ’র অবৈধ কর্মকর্তা-কর্মচারির দুর্নীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকারের দেয়া প্রকল্প নিয়ে যেমন অর্থ হরিলুট করা হয়েছে, তেমনি করা হয়েছে প্রতারণা। মাঝখানে আরডিএ কর্তৃপক্ষের জন্য রাজশাহীবাসী উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

আরডিএ প্রতিষ্ঠার পর নতুন কিছু সৃষ্টি হয়নি, বরং পুরাতনকেই ভেঙ্গে নতুন প্রকল্প করে চলেছে বাণিজ্য। সম্প্রতি সময় আরডিএ’র কিছু কাজ ও প্রকল্প পর্যালোচনা করলে এমনটাই দেখা যায়।

আরডিএ’র সবচেয়ে বড় কাজ চলছে রুয়েট থেকে বাইপাস পর্যন্ত সংযোগ সড়ক ও একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ। এই কাজের জন্য প্রায় ২শ’ ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু সরকারের এই উন্নয়ন কাজ প্রকল্প পরিচালকের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ। গত ২০২২ সালের জুনে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এ প্রকল্পটিও উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরও কাজ শেষ না হওয়ায় এটি উদ্বোধন হয়নি।

অথচ এই প্রকল্প গত বছরের ১৯ জুলাই কাজ শেষ দেখিয়েছে প্রকল্প পরিচালক। এ প্রকল্প নিয়ে প্রতিনিয়ত সরকার ও রাজশাহীবাসীর সাথে প্রতারণা করছেন আরডিএ’র প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক। প্রকল্পের কাজ শেষ না হতেই পূর্বের তারিখ দিয়ে একের পর এক চেক প্রদান করা হয়েছে ঠিকাদারকে, যা সম্পুর্ন অবৈধ। এছাড়াও এই প্রকল্পের অধিনে এখানো ১৮ কোটি টাকা ব্যাংকে থাকলেও প্রকল্প পরিচালক তথ্য গোপন করে ১৪ কোটি টাকা দেখিয়ে সরকারের চারকোটি টাকা হরিলুট করার চেষ্টা করছেন।

যদিও প্রকল্প পরিচালক তারিক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, সরকার টাকা দিতে দেরি করেছে তাই জুনের পর ঠিকাদারকে টাকা দেয়া হয়েছে। রাজশাহীর উপশহর এলাকার বাসিন্দা হযরত আলী বলেছিলেন, ওইখানে ফ্লাইওভারের দরকার ছিল না। এই কাজে প্রকল্প পরিচালক সরকারের সাথে যেমন প্রতারণা করছেন, তেমনি এ কাজে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে।

শুধু তাই নয়, আরডিএ’র যতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে সবখানেই তোপের মুখে পড়তে হয়েছে শুধু অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে। রাজশাহী নগরীর কোর্ট স্টেশন থেকে লিলি হল পর্যন্ত রাস্তা করার সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তোপের মুখে পড়েন প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক। সেখানে তাকে হাসুয়া নিয়ে তাড়া করেছিল স্থানীয়। এছাড়াও সম্প্রতি রুয়েট হতে বাইপাস রাস্তার জন্য অধিগ্রহনকৃত জমির টাকা না দিয়ে বাড়ি ভাঙ্গতে গেলে এই প্রকৌশলীকে কয়েকজন নারী মারপিট করে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল রাজশাহীর মাস্টার প্ল্যান। এই মাস্টার প্ল্যান নিয়েও নগরবাসীর সাথে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে মাস্টার প্ল্যানে নতুনত্ব তো ছিলই না, তার উপর প্রকল্প পরিচালক তথ্য গোপন করেছে। তথ্য গোপন করে প্রায় তিন কোটি টাকা নগর পরিকল্পনা শাখা গায়েব করার চেষ্টা করছেন।

নগর পরিকল্পক আজমেরী আশরাফী ২১ কোটি টাকার কাজ ১৮ কোটি দেখিয়ে প্রায় তিনকোটি টাকা হরিলুটের করার চেষ্টা করেছেন। শোনা যায়, এই এ টাকা নগর পরিকল্পক গত বছরের জুনের তারিখ দিয়ে পূর্বেও চেয়ারম্যানের সাক্ষর নিয়ে তুলেও নিয়েছেন। যদিও রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান ও সুশানের জন্য নাগরিকের সুব্রত পাল বক্তব্যে বলেছিলেন, মাস্টার প্ল্যান করতে এতো বিশাল অংকের টাকা লাগার কথা নয়। এখানে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে।

আগে ২০০৪ সালের এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আরডিএ কর্তৃপক্ষ ১০জন কর্মচারিকের ১৬ বছর পর্যন্ত বয়স শিথিল করে চাকরি দিয়েছে। যার মামলা চলমান থাকলেও অনেকেই চাকরির মেয়দ শেষ করে অবসরে গেছেন, আবার কেউ কেউ অবসরের পথে। এখানেও আরডিএ কর্তৃপক্ষ বড় ধরনের দুর্নীতি করেছে, যা দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। একই সাথে আরডিএ’র সাবেক হিসাব রক্ষক একলাছ উদ্দিন নামে-বেনামে চেক করে ১৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যান। এমনকি এক বছরের পুরো নথি গায়েব করার ঘটনাও আরডিএতে রয়েছে।

এছাড়াও, আরডিএ’র নন অবজেকশন সাটির্ফিকেট (এনওসি), ভবন নির্মাণের জন্য প্ল্যান পাসের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। এছাড়াও অথরাইজড ও এস্টেট শাখায় কোনো গ্রাহক সেবা নিতে গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অসাদু আবদার পুরণ করার পরও বছরের পর বছর তাদের ঘুরতে হয়। নগরীর সচেতন মহলের বক্তব্যমতে আরডিএ কি দুর্নীতির মহাআখড়া।

এদিকে আরডিএ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত নগরীর বাইরে যেমন প্রকল্প তৈরি করতে পারেনি, তেমনি শহরের গন্ডিও পেরোতে পারেনি। যেখানে রাসিক শহরের পরিধি বৃদ্ধি জন্য চেষ্টা করছে। আরডিএ কর্তৃপক্ষ সেখানে শহরের মধ্যে যা আছে তাই ভেঙ্গে চুরে প্রকল্প তৈরি করে বাণিজ্য করছে। এখন প্রশ্ন হলো, এতো দুর্নীতির পর কোন অলৌকিক শক্তির বলে টিকে আছে আরডিএ কর্তৃপক্ষ। কিসের ক্ষমতা বলে বছরের পর বছর দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।

এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ খোদ আরডিএ’র চেয়ারম্যান জিয়াউল হক। চেয়ারম্যান নিজে যেমন সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন না, তেমনি কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতেও নিষেধ করেছেন। এতে আরডিএ’র স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, তেমনি এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে নগরবাসীর ক্ষোভও দীর্ঘ হচ্ছে।

স/আ