দুর্গাপূজা ট্রাজেডি ২০২১ এবং বাংলাদেশ: একজন নাগরিকের চিন্তা ও আকুতি

১. অতি সম্প্রতি কুমিল্লা, ফেনী, রংপুর এবং আরো কিছু জায়গায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনদের ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা পালনের সময় ধর্মীয় অবমাননার নামে যে ন্যাক্কারজনক হামলা, পূজামণ্ডপ এবং মূর্তি ভাংচুর, বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ, হিন্দুদের জীবন এবং সম্পদের ওপর আক্রমণসহ যে সকল মানবতাবিরোধী জঘন্য ঘটনা ঘটেছে তার তীব্র নিন্দা প্রকাশ করছি। এই ঘটনাগুলো আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। কোনো কারণ বা যুক্তি দেখিয়ে এই কর্মকান্ডকে জাস্টিফাই করা গর্হিত এবং অগ্রহণযোগ্য। গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করছি সেই সকল পরিবারের প্রতি যারা তাদের প্রিয় সদস্যকে হারিয়েছে অথবা এই ঘটনার ফলে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে

২. আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি যে, কোনো ধর্মপ্রাণ হিন্দু ভাই-বোন হনুমান মূর্তির পায়ের উপরে পবিত্র কোরআন রাখার মতো অবমাননাকর কাজ করতে পারে না, ঠিক তেমনি কোনো প্রকৃত মুসলমানের পক্ষেও এমন জঘন্য কাজ ঘটানো অসম্ভব। আমি মনে করি এখানে তৃতীয় কোনো একটা পক্ষ আছে যারা এসব উসকানি ছড়িয়ে, সুপরিকল্পিতভাবে মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের লাশের উপরে দাঁড়িয়ে নিজেদের উদ্দেশ্যে হাসিল করতে চায়। উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথা বলাই যায় যে, কেবল ধর্ম নয় বরং অতিমাত্রার স্থানীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতির অনেক হিসেব-নিকেশ এই ধরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে, কাজেই ঘটনাকে সরলীকরণ করে উপসংহারে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। এটা বের করার দায়িত্ব এবং শক্তি একমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্রের আছে, কাজেই এটা রাষ্ট্রকেই করতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে। সকল ধর্মই মানবতার শিক্ষা দেয়। অন্য ধর্মকে অবমাননা কোনো ধার্মিকের পরিচয় নয়।

৩. হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির স্থাপনকারী বাংলাদেশ এই জঘন্য ঘটনগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেনা। হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক হৃদ্যতা, আত্মার বন্ধন আমাদের পরম ঐতিহ্য। ধর্ম যার যার, কিন্তু রাষ্ট্র সবার। এই রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের পবিত্র সংবিধান (ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ-বিশ্বাস নির্বিশেষে)। জনগণকে সোচ্চার থাকতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন কর্মকান্ড পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অবমাননা এতো ঠুনকো কোনো বিষয় নয় যে, কোনো দুর্বৃত্ত সমাজকে অস্থির করে ফেলার জন্য, দাঙ্গা সৃষ্টি করার জন্য, মূর্তির পায়ের উপরে পবিত্র কোরআন রাখলো অথবা মন্দিরে গোমাংস ফেলে দিলো আর সঙ্গে সঙ্গে সব ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় নামতে হবে, আইন হাতে তুলে নিতে হবে এবং একের শাস্তি অন্যকে দিতে হবে। আমাদের পবিত্র ইসলাম ধর্মে এটি মারাত্মকভাবে নিষিদ্ধ যে, কোনো মুসলমান কোনো মুসলমান বা অমুসলমান ভাই-বোনকে বিন্দু পরিমান কষ্ট দিতে পারে। আর ধর্মের নামে এই ধরণের জ্বালাও-পোড়াও তো কল্পনাই করা যায় না। কোনো অবস্থাতেই ষড়যন্ত্রকারীদের এই ধরণের ফাঁদে পা দেওয়া, উগ্রতার পরিচয় দেওয়া কোনো বিশ্বাসী সুনাগরিকের কাজ হতে পারে না। যদি কোনো অন্যায় বা ধর্মীয় অবমাননা হয়, তবে সেটি দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের তথা রাষ্ট্রের, কোনো ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নয়।

৪. আমাদের এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে কোনো ব্লেম গেম খেলা উচিত নয়। সকলকেই আক্রান্ত বা চরম ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়া হিন্দু ভাই-বোনদের পাশে ভালোবাসা এবং সম্মান নিয়ে দাঁড়ানো উচিত। এই বাংলাদেশ এমন লজ্জাকর পরিস্থিতি যেন আর না দেখে এটাই সকলের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা হওয়া উচিত। কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের নাগরিক যেন এই ভূমিতে জন্ম নেওয়াকে পাপ ভাবতে না পারে সেটি দেখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

৫. ধর্মীয় বা অন্য কোনো পরিচয় নয় বরং সন্ত্রাসী এবং দুর্বৃত্ত পরিচয়ে যে সকল বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ নামের জানোয়াররা এই কাজের সঙ্গে জড়িত, সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের উচিত সরকারকে সহযোগিতা করা যাতে করে সরকার এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারে। গড়িমসি বা অতীতের ন্যায় বিচারহীনতার সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি যদি প্রশাসন তথা সরকার করতে চায়, তবে জনগণকে তাদের স্ব-স্ব জায়গায় প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে।
ভালো থাকুক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, উপজাতিসহ সকল বাংলাদেশী। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখক: ড. এম. এল. রায়হান
গবেষক, কিয়োটো ইউনিভার্সিটি, জাপান

 

সূত্রঃ যুগান্তর