দুই শিশুর কথা ভেবেই হয়তো নিজে আত্মঘাতি হয়নি জঙ্গি সুমাইয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঘটনার দিন ১১ মে সকাল প্রায় পৌনে আটটা। গোদাগাড়ীর বেনিপুরের জঙ্গি আস্তানায় জঙ্গিদের মজুদ করা আরো বোমা থাকতে পারে-এমন সন্দেহে এবং সেগুলো নিস্ক্রিয় করার জন্য বাইরে থেকে পানি ছেটাচ্ছিলেন। কিন্তু ভিতরে অবস্থান নেওয়া জঙ্গিরা একসঙ্গে বের হয়ে ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের ওপরে প্রথমে আত্মঘাতি বোমা হামলা করে। এসময় আব্দুল মতিন নামের এক ফায়ারকর্মীকে জঙ্গিরা ধরে ফেলে তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে এবং বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার চেষ্টা চালাতে থাকে।

 

এসময় পুলিশ ওই ফায়ারকর্মীকে উদ্ধার করতে গেলে আরো একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এককপর্যায় পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ে। পরে ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় ফায়ারকর্মী আব্দুল মতিনসহ চার পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে রামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে হাসপাতালে পৌঁছার পরে ফায়ারকর্মী আব্দুল মতিনকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। অন্যদিকে ঘটনাস্থলে জঙ্গি সাজ্জাদ আলী, তাঁর স্ত্রী দুই ছেলে, এক মেয়ে ও আশরাফুল ইসলাম নামের এক জঙ্গির লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

 

এদিকে, জঙ্গিদের হামলা এবং পুলিশের পাল্টা হামলার সময় ওই বাড়ি থেকে জঙ্গি সাজ্জাদের বড় মেয়ে সুমাইয়া তাঁর দুই শিশু সন্তানকে নিয়েও বাড়ির বাইরে আসেন। তবে তিনি দেড় মাসের মেয়ে শিশু সন্তানকে নিয়ে তিনি একটু দূরেই অবস্থান করছিলেন। অভিযানের সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে তার কোলে থাকা শিশুটিকে দেখাচ্ছিলেন। এসময় তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আরেক শিশু সন্তান জোবায়ের।

 

পরে পুলিশ মাইকযোগে সুমাইয়াকে আহ্বান জানান, তিনি যেন তার ছোট শিশুটিকে আরেক শিশু জোবায়েরের কোলে তুলে দেন। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুমাইয়া তার দেড় মাসের শিশুটিকে বড় ছেলে জোবাইয়েরের কোলে তুলে দেন। এরপর থেকে সুমাইয়া ওখানেই বসে ছিলেন। তবে পুলিশ ধারণা করছিল, তার নিকট হয়তো আত্মঘাতি বোমা আছে-এমন সন্দেহে পুলিশ তাকে কাছে ভীড়তে দিচ্ছিল না। একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে কাপড় কিছু দূরে রেখে আসা হয়। পাশাপাশি সুমাইয়াকে তার পরিধেয় কাপড় ছেড়ে দিয়ে পুলিশের কাপড় পরতে বলা হয়। সেই আহ্বানেও্ সুমাইয়া সাড়া দিয়ে শেষে আত্মসর্মপর্ণ করেন তিনি।

 

গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, দুই শিশুর কথা ভেবেই হয়তো নিজে আত্মঘাতি হয়নি জঙ্গি সুমাইয়া। তবে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অনেক তথ্যই দিয়েছে পুলিশ।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বেনিপুরে ‘অপারেশন সান ডেভিল’-এর সময় দুই শিশুসহ আত্মসমর্পণকারী ‘জঙ্গি’ সুমাইয়া খাতুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ১৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে গতকাল রবিবার রাজশাহীর জ্যেষ্ঠ বিচার বিভাগীয় হাকিম আদালতে তাকে সোপর্দ করা হয়। শুনানির পর বিচারক সাইফুল ইসলাম সুমাইয়ার ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এদিকে পুলিশ বলছে, সুমাইয়াকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে যে আত্মঘাতী হামলা চালালে বেহেশত পাবে এমন অন্ধবিশ্বাস থেকেই জঙ্গিরা পুলিশের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল। পুলিশকে তারা কাফের আখ্যা দিয়েই এ পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী, একযোগে বেরিয়ে এসে হামলা চালায়।

পুলিশ ধারণা করছে, কোলে দেড় মাসের এবং সঙ্গে সাত বছরের আরেকটি শিশুসন্তান থাকায় তাদের কথা ভেবেই হয়তো সুমাইয়া আত্মঘাতী হামলায় অংশ নেয়নি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোদাগাড়ী থানার ওসি (তদন্ত) আলতাফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সুমাইয়াকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ‘অপারেশন সান ডেভিল’ চলাকালে ফায়ারম্যান ও পুলিশের ওপর পরিকল্পিত হামলা এবং তার জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে। এ ছাড়া আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে সে। তবে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করতে এবং আরো নতুন নতুন তথ্য পেতে সুমাইয়াকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন। তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। তবে আদালত শুনানি শেষে ১০ রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে কড়া নিরাপত্তায় সুমাইয়াকে গোদাগাড়ী থানা থেকে রাজশাহী আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় সুমাইয়ার গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট ছিল। সঙ্গে তার দুই সন্তানও ছিল। আদালতে হাজির করা থেকে রিমান্ড আবেদনের শুনানি এবং আবার বেরিয়ে যাওয়া মিলে ১৫ মিনিটের মতো সময় লেগেছে। সুমাইয়াকে আদালত থেকে সরাসরি গোদাগাড়ী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সুমাইয়ার বাবা আত্মঘাতী বোমায় নিহত সাজ্জাদ আলীর বাড়িতে আর কোন কোন জঙ্গি আসা-যাওয়া করত; রাজশাহী অঞ্চলের আর কারা এই জঙ্গি আস্তানায় আসত সে ব্যাপারেও অনেক তথ্য পেয়েছে পুলিশ। সুমাইয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযানও পরিচালনা করেছে। তবে তদন্ত এবং জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার স্বার্থে এ নিয়ে এখনই বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি পুলিশ কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, গত ১০ মে রাত ৩টা থেকে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে গোদাগাড়ীর বেনিপুর গ্রামে বিলের মধ্যে সাজ্জাদ আলীর বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। পরদিন সকালে অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় একসঙ্গে পাঁচজন ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ফায়ারম্যান ও পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তারা ফায়ারম্যান আবদুল মতিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায় এবং আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ফায়ারম্যান আবদুল মতিনসহ ছয়জন নিহত হয়।

স/আর