ময়মনসিংহের একটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলো কিছুদিন আগে। দীর্ঘদিন এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় এমপি। বয়সে প্রবীণ এই নেতা বারবার জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দলের কাছে অনুরোধ ছিল সভাপতির দায়িত্বে তিনি আরও একবার থাকতে চান। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক গ্রুপ এমপির বড় ছেলেকে দাঁড় করালেন বাবার বিপক্ষে। বাকি সন্তানরা অবস্থান নিলেন বাবার পক্ষে। তাঁরা অনুরোধ করলেন ভাইকে নয়, বাবাকে রাখুন। কেন্দ্র থেকে যাওয়া নেতারা পড়লেন বিপাকে। তাঁরা সম্মেলনস্থল থেকে ফিরলেন ময়মনসিংহ শহরে। এমপিপুত্র ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশের নেতাদের নিয়ে কমিটি ঘোষণা করে চলে এলেন ঢাকায়। এ খবর এমপি পরিবারের বাকি সদস্যরা ভালোভাবে নেননি। এমপিপত্নী অসুস্থ হয়ে গেলেন হাসপাতালে। এমপি নীরবে অশ্রু ফেলছেন। অন্য সন্তানরা বিস্ময় নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে করলেন সাক্ষাৎ। তাঁরা বললেন, শেষ বয়সে তাঁদের বাবাকে রাখা হোক সভাপতি পদে। তাঁদের মা এ নিয়ে অসুস্থ। তিনিও দলের জন্য অনেক ভূমিকা রেখেছেন। বাবার শরীরও ভালো যাচ্ছে না। ভাইকে ভবিষ্যতে দেখার অনেক সময় আছে। কিন্তু কেন্দ্র আর এ নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। এভাবে ঘরের ভিতরের আগুনে পুড়ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
করোনাকালে নতুন নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। ঢাকার রাজনীতিতে মোহাম্মদ হানিফ পরিবার ছিটকে পড়েছে। হানিফপুত্র সাঈদ খোকন এখন অনেকটা রাজনীতির বাইরে। এ পরিবারের অনুসারীরা ঢাকার রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে চুপচাপ। দিন ভালো যাচ্ছে না হাজী সেলিম পরিবারেরও। তাঁরাও এখন অনেক কিছুতে নেই। হাজী সেলিম অনেক দিন থেকে কথা বলতে পারেন না। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে সবকিছু পরিচালনা করেন। ভেবেছিলেন সন্তানকে সামনে আনবেন। এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ দুর্গে ফাটল ধরেছে। মূল শহরের নেতৃত্বেও টানাপোড়েন। ক্যাসিনোকাণ্ড ঘিরে ঢাকার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন নগর যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। দীর্ঘদিন থেকে সম্রাট কারান্তরিন। ঢাকা সিটিতে সম্রাটের একটা বিশাল বলয় ছিল। এ বলয়ই তাঁর কাল হয়ে উঠল। সম্রাটের পরিবারের সদস্যরা সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। বলছেন, একই অপরাধে আটক লোকমান ছাড়া পেলে সম্রাট নন কেন? প্রশ্নের জবাব মিলছে না। সম্রাটের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের আবেদন-নিবেদনে বলছেন, তাঁর শরীর ভালো নেই। বারবার হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। সরকারের ভিতরেও এ নিয়ে কথা হচ্ছে। আলাপ-আলোচনা হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে শুধু দেশি রাজনীতি একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ আগামী দিনের বিশ্বরাজনীতির হিসাব বদলে দেবে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘিরে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত লেগেই আছে। শেখ হাসিনার বিশাল উন্নয়ন সাফল্যের বিপরীতে দেশ-বিদেশে মিথ্যা প্রচারণা সরকার রুখতে পারছে না। পাল্টা জবাবও দিতে পারছে না। সরকারের লোকজন মনে করেন সবকিছু আসমান থেকে সমাধান হবে। কিন্তু আসমান থেকে কোনো কিছুর সমাধান আসে না। সারা দেশের প্রার্থীরা সবাই নারায়ণগঞ্জের সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো জনপ্রিয় নন। নিজের পায়ের নিচে সবার মাটি শক্ত নয়। অনেক মন্ত্রী-এমপি এলাকায় যান না। কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। করোনা এ দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাই লীগ, এমপি লীগে কর্মীরা খুশি নন। শরিকদের সঙ্গে জোটের দূরত্ব বাড়ছে। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা এখন কোনোমতে টিকে থেকে বাকি জীবনটা দলে কাটানোর সংগ্রামেই আছেন। অনেকে নীরব অভিমানে চুপ মেরেছেন। এ পরিস্থিতি ভালো কিছু নয়। সরকারে থাকলে একটি দলে সমস্যা হবেই। কিন্তু সমস্যার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে পাহাড়ে রূপ নিলেই জটিলতা তৈরি হয়। যা পরে সামাল দেওয়া যায় না। নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
রাজনীতিতে সংকট বলে কয়ে আসে না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন পার করলে কী হচ্ছে অনুধাবন করা যায় না। আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার কথা আগে থেকে জানতে না পারা এক ধরনের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। এত দিন পর সরকারের পক্ষে কেউ কেউ লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিচ্ছেন। আগে থেকে সতর্ক থাকলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আজ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ত না। অনেকেই মনে করেন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে একটি গ্রুপ এর পেছনে লেগে ছিল, এখনো লেগে আছে। আমেরিকায় ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে সব সময় সারা দুনিয়ার মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের দিকে নজর দেয়। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের দিকে আমেরিকান চোখ কেন গেল বুঝতে হবে আরও গভীরভাবে। এটা শুধু মানবাধিকার ঘিরে নয়। বাস্তবতা ঘিরেই কাজ করতে হবে আগামীতে। যেনতেন নির্বাচন আগামীতে না-ও হতে পারে। কঠিন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করবেন ক্ষমতাসীনদের সে হিসাব-নিকাশ করতে হবে। শুধু উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে লাভ হবে না। উন্নয়ন হলে দুর্নীতি কমবেশি হবে- এমন কথায়ও চিঁড়া ভিজবে না।
করোনা পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দিয়েছে। যুদ্ধ বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। অর্থনীতির ওপর সারা দুনিয়াতেই একটা কঠোর আঘাত আসবে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। পশ্চিমাদের নানামুখী পলিসির দিকে নজর রাখতে হবে। তাদের অনেক হিসাব-নিকাশ আমাদের সঙ্গে মিলবে না। কিন্তু তাদের বাইরে গিয়ে উঠতি অর্থনীতির একটি দেশ কতক্ষণ সক্রিয়তা ধরে রাখতে পারবে? জাতিসংঘে নেপাল ভোট দিয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব সমর্থন করে। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় অসহায়দের পক্ষে। অতি আবেগে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের ক্ষতির কথা চিন্তা করিনি। রাশিয়া ১৯৭১ সালে আমাদের সমর্থন দিয়েছে। অবশ্যই রাশিয়া আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। কিন্তু এখন বিশ্ববাস্তবতার বাইরে আমরা কীভাবে যাব? পশ্চিমা অর্থনীতির প্রতি আমাদের নির্ভরশীলতা পুরোপুরি। সেই নির্ভরশীলতার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে থাকতে পারত। আবার আমাদের কোনো নাগরিক যাতে ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে সেদিকেও দৃষ্টি রাখা জরুরি।
যুদ্ধ পৃথিবীর উন্নতি-সমৃদ্ধি ধ্বংস করে। মানবতা করে ভূলুণ্ঠিত। ধ্বংস করে সভ্যতা। ইতিহাস তা-ই বলে। রাশিয়ার আগ্রাসী ভূমিকা এখন পৃথিবীকে নিয়ে যাচ্ছে কিয়ামতের দিকে। বর্তমান পরিস্থিতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে। বাংলাদেশ যুদ্ধ নয়, শান্তির পক্ষে। আর শান্তির জন্যই নিন্দা প্রস্তাবে বাংলাদেশের সমর্থন দেওয়া দরকার ছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। আগামী দিনে বিশে^র মানচিত্র থেকে হয়তো ইউক্রেন নামক দেশটির অস্তিত্ব রাশিয়া মুছে দিতে পারে। কিন্তু এতে সংকটের শেষ হচ্ছে না। বরং বিশ্ব এক নতুন সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইউক্রেনের পর পুতিন নজর দেবেন আরও তিনটি দেশের প্রতি। তার মধ্যে ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ যোগ হলে ফল কী দাঁড়াবে? বিশ্ব কি সামাল দিতে পারবে সে পরিস্থিতি? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবীর জনসংখ্যার বড় অংশই বিলুপ্ত হবে। অর্থনীতি আর রাজনীতি নিয়ে আলাপের কিছু থাকবে না। একটা ভয়াবহ মহামারি এখনো শেষ হয়নি। আগামী শীতে করোনা মহামারি বাড়বে না কমবে, কেউ জানে না। এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিশ্বকে নতুন হুমকিতে ফেলেছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ক্ষমতাসীনদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েই এ সরকারকে কাটাতে হবে আরও এক বছর ১০ মাস। সরকারের সামনে দুই চ্যালেঞ্জ- একদিকে যুদ্ধের অর্থনীতি সামাল দেওয়া, অন্যদিকে করোনার ক্ষতি মোকাবিলা। এ দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই জড়াতে হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশে^র সবচেয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তিনি সবচেয়ে বেশি সময় একটি দলের দায়িত্বে। টানা তিনবারের ক্ষমতার রেকর্ডও তাঁর। নিজের রেকর্ড ভাঙতে তিনি চতুর্থবারের মতো লড়বেন আগামী ভোটে। তাঁর একক ইমেজের ওপর ভর করেই আওয়ামী লীগ সে প্রস্তুতি নিচ্ছে। দল ও সরকারে প্রশ্নবিদ্ধ কিছু অবস্থান থাকলেও শেখ হাসিনার একটাই সুবিধা- মানুষের একক আস্থা রয়েছে তাঁর ওপর। জনগণের সেইআস্থার ওপর ভর করেই শেখ হাসিনা এগিয়ে চলছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা দিয়েছেন উন্নতি ও সমৃদ্ধি। বাংলাদেশ বিশে^ নতুনভাবে প্রশংসিত অর্থনৈতিক অবস্থানে শেখ হাসিনার সফলতার কারণেই। ভারত, পাকিস্তান এখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঈর্ষার চোখে দেখছে। এ অবস্থানে দেশকে এনেছেন শেখ হাসিনা। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরসা শুধু শেখ হাসিনার একক ইমেজ। তবে এ ইমেজের বিপরীতে চ্যালেঞ্জ মোটেও কম নয়। নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকট, জটিলতা, আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিগ্রহ, দেশ-বিদেশে কুৎসায় মাঝেমধ্যে ক্ষমতাসীনদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এর জবাব দিয়ে কীভাবে সবকিছু সামলে দলটি এগিয়ে যাবে তা স্পষ্ট নয়। পাশাপাশি এ বছরের শেষে দক্ষ ও যোগ্য নেতারা কীভাবে আগামী কাউন্সিলে সামনের কাতারে আসবেন তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। তবে আগামী বছর এমন সময়ই অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠবে সবার সামনে।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।