নিজস্ব প্রতিবেদক:
সীমান্ত অবকাশ, সীমান্ত নোঙ্গর, লালন শাহ পার্ক, ফাস্ট ফুড, কফি বার, পদ্মা গার্ডেন বাহারি এই নামগুলো সবই রাজশাহী শহররক্ষা বাঁধ বা পদ্মা নদীর তীর ঘিরে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনার।
- রাজশাহী সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে বর্ডার গার্ড বিজিবি এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা ‘ফাস্ট ফুড’র জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছেন নদী বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে। এর ফলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর পদ্মাকে ঘিরে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ফলে নদী বা তার সৌন্দর্য দেখতে এসে নিরাশ হচ্ছেন মানুষ।
সর্বশেষ গত কয়েকদিন ধরে নগরীর ঐতিবাহী বড়কুঠি এলাকায় পদ্মার তীর দখল করে স্থানীয় যুবলীকর্মী মুন্না রহমান একটি ফাস্টফুড কর্ণার নির্মাণ করছেন। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তৈরীকৃত শহররক্ষা বাঁধের ফুটপাত দখল করে এ ফাস্টফুড কর্ণারটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে দখলকৃত ওই স্থানের পাশেই রয়েছে ‘কফি বার’ নামের আরেকটি অবৈধ স্থাপনা। বড়কুঠি এলাকার এই বিশাল জায়গাটি দখল করেছে সয়ং রাজশাহী সিটি করপোরেশন। সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের আমলে এ স্থানটি দখল করে নামেমাত্র লিজ দেওয়া হয় স্থানীয় যুবলীগ নেতা সাহাজাদর কাছে। এরপর থেকে বছর বছর লিজ নবায়ন করে সেখানে ফাস্টফুডের ব্যবসা করে চলেছেন সাহাজাদা।
বড়কুঠির সামনে কিছু দূর যেতেই পদ্মার তীর দখল করে দীর্ঘদিন ধরে ফাস্টফুডের ব্যবসা করে চলেছেন দরগাপাড়া এলাকার স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহিদ হাসান। অন্তত ১৫ বছর ধরে ওই জায়গাটি পদ্মা গার্ডেন নাম দিয়ে তিনি দখলে রেখেছেন।
তবে জাহিদ হাসান দাবি করেন, সেখানে তাদের নিজস্ব কিছু সম্পত্তিও রয়েছে। তাই জায়গাটি তিনি দখল করে ফাস্টফুডের ব্যবসা করছেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ২০১৪ সালের পদ্মা গার্ডেনের পশ্চিম দিকে শহর রক্ষা বাঁধের নিচে অন্তত ৩ একর জায়গা দখল সেখানে লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে নগর সংস্থা। এরপর শহররক্ষা বাঁধের ওপর থেকে ওই জায়গাটি কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলার কাজ শুরু করা হয়।
- এ নিয়ে সিল্কসিটি নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হলে কাটা তারের বেড়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন স্থানীয়রা। পরে কাটা তারের বেড়া দিয়ে জায়গাটি ঘিরে ফেলা হলেও আর লিজ দেওয়া হয়নি। তবে ওই স্থানে নদীর সৌন্দর্য দেখতে যাওয়া শত শত মানুষকে এখনো বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে কাটা তারের বেড়ার কারণে।
এই জায়গাটিও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ হাসানকে লিজ দিতে উঠে পড়ে লেগেছিল রাসিক। লিজ দেওয়ার পরে সেখানে ১০ টাকা করে টিকিট চালু করার কথা ছিল নদীর সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের নিকট থেকে। তবে স্থানীয়দের বাধারমুখে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
- লালন শাহ পার্কের ঠিক কয়েক গজ দূরেই নদীর তীর দখল করে শহররক্ষা বাঁধের নিচে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সীমান্ত নোঙ্গর’ নামে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) পরিচালিত একটি ফাস্টফুড কর্ণার।
বিশালকার একটি আমবাগ ঘিরে এবং নদীরও বেশকিছু এলাকা দখল করে এখানে ভবন নির্মাণ করে ওই ফাস্টফুড কর্ণারটি গড়ে তোলা হয়েছে গত ৪-৫ বছর আগে। এরপর থেক্রে ক্রমেই নদীর জায়গা দখল করে ফাস্টফুড কর্ণারের বিস্তার করা হচ্ছে। এ নিয়ে রাজশাহীর সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ থাকলেও সয়ং বিজিবি জায়গাটি দখল করায় কেউ প্রতিবাদে নামতে সাহস পায়নি।
সীমান্ত নোঙ্গর গড়ে তোলার বছর দুয়েকের মধ্যে তার পাশে পশ্চিম দিকে আরেকটি আম বাগান ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বা নদীর জায়গা দখল করে শহর রক্ষা বাঁধের নিচে গড়ে তোলা হচ্ছে সীমান্তে অবকাশ নামের অপর একটি ফাস্ট ফুড কর্ণার।
- বিশালকার এই জায়গাতেও গড়ে তোলা হয়েছে স্থায়ী ভবন। এর জন্য একটি বিশালকার বট গাছও কেটে সাবাড় করা হয়েছে। যেনি বেড়ে উঠেছিল শহররক্ষা বাঁধের ওপরেই।
আবার সীমান্ত অবকাশ ঘেঁেষ পশ্চিমে একেবারে নদীর মধ্যেকার জায়গা দখল করে সেখানে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জন্য কারা প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলারও প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।
ওই জায়গাটির দখল পাল্টা দখল নিয়ে সম্প্রতি বিজিবির সঙ্গে কারারক্ষীদের উত্তেজনাও দেখা দেয়। রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে লিজমূলে ওই জায়গাটিতে কারা প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে দাবি করেন রাজশাহী
কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ কারাগারের পেছনে দক্ষিণ পাশে নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মার তীরের নিচে ২০৮ শতাংশ জমি জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে লিজ গ্রহণ করে। এর পর থেকে ১৮৫ বছর ধরে কারা কর্তৃপক্ষ সেই জায়গার খাজনা দিয়ে আসছে। এরই মধ্যে সেখানে কারা একাডেমী করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
- এর বাইরে পদ্মা তীরবর্তি রাজশাহী নগরীর আরো বিভিন্ন স্থানে শররক্ষা বাঁধ বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল আরো কিছু ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে করে একদিকে যেমন নদীর সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে, তেমনি হুমকির মুখে পড়ছে শহররক্ষা বাঁধ। বাঁধের ওপরে অবাধ বিচরণের ফলে বার বার বিভিন্ন স্থানে ভেঙেও যাচ্ছে। কিন্তু তার পরেও থেমে নেই এ দখলযাত্রা।
নদী বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, কিছু জায়গা সৌন্দর্য বর্ধন করে সেগুলো লিজ দেওয়া হয়েছে। এতে করে বিনোদন পীপাশু মানুষ পদ্মা নদীর ধারে ঘুরতে গিয়ে কিছুটা হলেও প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছে।
তবে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মখলেছুর রহমান বলেন, ‘বার বার চিঠি দেওয়ার পরও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করা হচ্ছে। এসব কখনো কখনো করছে রাসিক নিজেই। তারপরেও দখলমুক্ত করতে প্রয়োজনে আমরা নতুন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
স/আর