থ্যালাসেমিয়া : সচেতন হোন, যত্ন নিন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

প্রতিবছর ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালিত হয়। থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশনের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা পানস ইংলেজোস ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবসের প্রবর্তক। তাঁর ছেলে জর্জের মৃত্যু হয়েছিল থ্যালাসেমিয়ায়। প্রতিবছর থ্যালাসেমিয়া দিবস উপলক্ষে থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে।

এবারের প্রতিপাদ্য ‘সচেতন হোন, শেয়ার করুন ও যত্ন নিন : থ্যালাসেমিয়া জ্ঞান উন্নত করার জন্য সারা বিশ্বসম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করুন। ’

প্রতিপাদ্য বিষয়টি যদি দেখি, তাহলেই বুঝতে পারব থ্যালাসেমিয়া রোগটির জন্য সচেতনতা গড়ে তোলা কত গুরুত্বপূর্ণ।

থ্যালাসেমিয়া রোগে রক্তে হিমোগ্লোবিন কণা উৎপাদনে সমস্যা হয়। অর্থাৎ অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা থাকে। এটি অটোজোমাল মিউট্যান্ট প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত রক্তের রোগ; মা-বাবার কাছ থেকে সন্তানের শরীরে আসে। ১৯২৫ সালে আমেরিকার টমাস কুলি ও পারোল লি এই রোগটি চিহ্নিত করেন। থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সর্বত্র।

থ্যালাসেমিয়া রোগটি প্রধানত দুই প্রকার। মেজর ও মাইনর। বাহকরা মাইনর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্ম নিলে সেটি মেজর থ্যালাসেমিয়া। এর বাইরে আছে আলফা ও বিটা। আলফা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি। বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা অনেক বেশি।

থ্যালাসেমিয়া মেজর কুলিস অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত সন্তান সাধারণত ৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। মা ও বাবা কিংবা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জিন থেকে ভূমিষ্ঠ শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়, শতকরা ২৫ ভাগ সুস্থ হয়ে জন্মগ্রহণ করে, শতকরা ৫০ ভাগ রোগী বাহক হিসেবে জন্ম নেয়।

থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি করতে দেওয়া যেতে পারে। সেখানে যদি হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ও মিন করপাসকুলার ভলিউম কম পাওয়া যায়, তাহলে থ্যালাসেমিয়া ধারণা করা যেতে পারে। এর সঙ্গে ব্লাড ফিল্ম করলে দেখতে পাওয়া যাবে মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রমিক অ্যানিমিয়া ও টার্গেট সেল। এ ছাড়া সেরাম আয়রন, ফেরিটিন, ট্রান্সফরিন লেভেল অনেক বেশি থাকে। নিশ্চিতকরণ টেস্ট হিসেবে হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষা করেও থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় করা যায়।

মাইনর থ্যালাসেমিয়ায় সাধারণত কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে থ্যালাসেমিয়া মেজরে নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করা প্রধান চিকিৎসা। এরপর বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন) অথবা সেপ্লনেক্টমি করা হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন একটি কার্যকর চিকিৎসা।

থ্যালাসেমিয়া মেজরের প্রধান চিকিৎসা নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন। বারবার রক্ত নেওয়ার পর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত আয়রন বা লৌহ জমে যেতে থাকে, যাকে আমরা হেমোকোমোটোসিস বলি। এই হেমোকোমোটোসিসের ফলে যকৃৎ বিকল, সিরোসিস, হাইপোথাইরয়েডিজম, ডায়াবেটিস মেলাইটাস, অ্যাবনরমাল হার্টবিট, পেরিকাডাইটিস হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। এ ধরনের জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপি (ফবভবত্ড়ীধসরহব) দেওয়া হয়, যেটি অতিরিক্ত আয়রন শরীর থেকে বের করে দেয়।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা খুবই জরুরি। সচেতনতা ও পর্যাপ্ত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় করে এই রোগের হার কমিয়ে আনা যেতে পারে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের যেকোনো একজন যদি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকেন, সে ক্ষেত্রে নবজাতকের থ্যালাসেমিক হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তবে তারা বাহক হতে পারে।

এই রোগের বাহকদের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহ করার মাধ্যমে নতুন থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জন্ম কমিয়ে ফেলা সম্ভব। আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহ করতে হবে। যেসব স্বামী-স্ত্রী দুজনই এ রোগের বাহক বা যাঁদের এক বা একাধিক থ্যালাসেমিক শিশু আছে, তাঁরা গর্ভস্থ ভ্রূণ পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিক শিশু নির্ণয় এবং তা পরিহার করতে পারেন। মনে রাখবেন, গর্ভাবস্থায় ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো ফল আসতে পারে।

প্রতিবছর আমাদের দেশে দেড় হাজারের বেশি এবং সারা বিশ্বে ১০ হাজারের বেশি শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। দেশের ১০-১২ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার জিনের বাহক। এমন একটি মহামারি রুখতে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত। ভুলে গেলে চলবে না ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর’।

বর্তমান সরকার থ্যালাসেমিয়ার জন্য বেশ কয়েকটি বড় সেন্টার চালু করেছে। সেখানে খুব কম খরচে উন্নতমানের চিকিৎসা পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শিশু হাসপাতাল থ্যালাসেমিয়া সেন্টার, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন ছাড়াও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে এবং চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে আসছে। এর পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ব্যাপক আকারে প্রচার চালাতে হবে। থ্যালাসেমিয়া রোগের ওষুধের দাম কমিয়ে আনতে হবে। স্ক্রিনিং বিনা মূল্যে করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

থ্যালাসেমিয়া রোগটি ছোঁয়াচে নয়। এই রোগটি বাহকের মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত শিশু জন্মের এক থেকে তিন বছরের মধ্যে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। আমাদের দেশের একটি বড় অংশ যুবসমাজ। এই যুবসমাজকে থ্যালাসেমিয়া থেকে উত্তরণের উপায় বোঝাতে এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে, পাশাপাশি বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিংয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এটি আমরা স্কুল ও কলেজ লেভেল থেকে শুরু করতে পারি। এ দেশের যুবসমাজ এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে এলে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসের লক্ষ্য বাংলাদেশ অর্জন করতে পারবে। মনে রাখতে হবে, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের নিয়মিত প্রচার চালিয়ে যেতে হবে।

বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস সফল হোক। আসুন, আমরা থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জানি, সচেতন হই। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করি।

লেখক : সিনিয়র ফিজিশিয়ান, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল; কার্যনির্বাহী সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ