তিন ঘণ্টায় বদলে গেল যুক্তরাষ্ট্র

নাইন ইলেভেন হামলা। যা ঘটে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। দিনটি শুধু মার্কিন নাগরিকদেরই নয়, সেদিন এই ঘটনাটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের কারও জন্যই ভোলার নয়।

যা মাত্র তিন ঘণ্টায় বিশ্বের একনম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে পুরোপুরি বদলে দেয়। এই হামলার ঘটনা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইকেও ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে।

নাইন ইলেভেন নিয়ে মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘতম তদন্তের সূচনা করে সংস্থাটি। হামলার জবাবে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এই লড়াইয়ে একের পর এক দেশের ওপর চলে সামরিক আগ্রাসন।

কিন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। বরং বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই কোনো না কোনোভাবে সে যুদ্ধের অংশ হয়ে পড়েছে। এর ফলে বদলে গেছে পুরো পৃথিবী।

বিপন্ন হয়ে পড়েছে বিশ্বের মানুষ। আর কথিত এই ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রই। রীতিমতো আঙুল ফুলে কলাগাছ এর শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো।

নাইন ইলেভেন হামলার দিন ছিল মঙ্গলবার। এদিন অনেকটা হলিউড সিনেমার কাহিনীর মতো ১৭১ মিনিট ধরে একের পর এক ঘটে চলল লোমহর্ষক ও নজিরবিহীন সব ঘটনা।

একই সময়ে একসঙ্গে চারটি বিমান ছিনতাই। এরপর গুরুত্বপূর্ণ একটার পর একটা ভবন টার্গেট করে বিমানের বিস্ফোরণ। যার আঘাতে প্রথমেই নিউইয়র্কের সবচেয়ে লম্বা ও আইকোনিক ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো।

এরপর দাউদাউ করে জ্বলে উঠল মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর ‘হৃৎপিণ্ড’ পেন্টাগন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ল কয়েক হাজার মানুষ। হতচকিত হয়ে পড়ল পুরো দেশ। কোটি কোটি নাগরিক বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিল, আমেরিকার মাটিতে এতবড় একটি হামলার ঘটনা কিভাবে ঘটল।

ঘটনার সূত্রপাত সকাল ৭টা ৫৯ মিনিটে। আমেরিকান এয়ারলাইনসের বোয়িং-৭৬৭ উড়োজাহাজটি আছড়ে পড়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর দিকের টাওয়ারে।

উড়োজাহাজটি ১১০ তলা ভবনটির ৮০তম তলায় ঢুকে পড়ে। হামলার সঙ্গে সঙ্গেই নিহত হন শত শত মানুষ, ভবনের ভেতরে আটকে পড়েন আরও অসংখ্য মানুষ।

১৮ মিনিট পরে, সকাল ৯টা ০৩ মিনিটে দ্বিতীয় বিমানটি হামলা চালায়। ইউনাইটেড এয়ারলাইনস ফ্লাইট ১৭৫-এর আরেকটি বোয়িং-৭৬৭ উড়োজাহাজ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দক্ষিণ দিকের টাওয়ারের ৬০তম তলায় আঘাত হানে।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে টুইন টাওয়ারের উত্তর দিকের ভবনটি ভেঙে পড়ে। ভবনটি ধসে পড়ার সময় ভেতরে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে মাত্র ছয়জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছিল। প্রায় ১০ হাজার মানুষকে গুরুতর আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর তৃতীয় হামলাটি হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর পেন্টাগনে। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে পেন্টাগনের পশ্চিম দিকে আঘাত করে আমেরিকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৭৭-এর বোয়িং-৭৫৭ উড়োজাহাজটি। পেন্টাগনে হামলায় ১২৫ জন সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হন বলে জানানো হয়। জিম্মি করা বিমানটির ভেতরে থাকা ৬৪ জনও নিহত হন। চতুর্থ বিমান হামলাটি হয় সকাল ১০টা ১০ মিনিটে। নিউজার্সি থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করার ৪০ মিনিট পর ইউনাইটেড ফ্লাইট ৯৩ নামের উড়োজাহাজটি ছিনতাই করা হয়।

বিমানে থাকা অবস্থাতেই যাত্রীরা নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হামলার বিষয়ে জেনে যান। পরে পশ্চিম পেনসিলভানিয়ার শ্যাংকসভিলের কাছে একটি ফাঁকা মাঠে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানে থাকা ৪৪ জনের সবাই নিহত হন। ঘটনার শেষ হয় সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে, বিমানের আঘাতে আংশিকভাবে ধসে পড়ে পেন্টাগনের পশ্চিম দেওয়াল।

হামলায় ১৯ জন হামলাকারীসহ মোট দুই হাজার ৯৯৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে শুধু ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে চালানো দুটি বিমান হামলায় মারা যান দুই হাজার ৭৬৩ জন। আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করতে গিয়ে ৩৪৩ জন দমকলকর্মী এবং ৬০ জন পুলিশ সদস্যও নিহত হন। চারটি হামলায় সম্মিলিতভাবে ৭৮টি দেশের মানুষ নিহত হন। নাইন-ইলেভেনের হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হামলার পর প্রথম দিনেই নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধস নামে। এক মাসেই চাকরি হারান এক লাখ ৪৩ হাজার মানুষ। ধারণা করা হয়, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলায় আনুমানিক ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়েছিল।

তবে পরবর্তী দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে যে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চালায় তা থেকে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে মার্কিন কোম্পানিগুলোর। ৯/১১ হামলার ২০তম বার্ষিকীতে প্রকাশিত এক রিপোর্ট মতে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ চলার সময় মার্কিন সেনাবাহিনী ও সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ক্যাম্পেইন গ্রুপের প্রকাশিত ‘বিগ টেক সেলস ওয়ার’ শীর্ষক রিপোর্টে এ কথা জানিয়ে বলা হয়, ২০০৪ সাল থেকে সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে আমাজন, ফেসবুক, গুগল, মাইক্রোসফট এবং টুইটার এই বিপুল অর্থ আয় করেছে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ জড়িত কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর চুক্তি ছিল। ‘২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিগ টেক করপোরেশনগুলো বিশেষ করে পেন্টাগন ও ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির চাহিদা পূরণ ও পরিষেবা দেওয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছে।

২০০১ সালের পর থেকে প্রতিরক্ষা শিল্প ডিজিটাল করার চেষ্টা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ক্লাউড কম্পিউটিং ও জিপিএস সফটওয়ার চাহিদা পূরণে বিগ টেক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়। শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা বিভাগ ২০০৪ সাল থেকে বিগ টেকের জন্য ৪৩.৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।

 

সূত্রঃ যুগান্তর