সপ্তার ব্যবধানে পাঁচ ব্যবসায়ীর ২ লক্ষ টাকা জরিমানা

তানোরে সারের দাম নিয়ন্ত্রণে চলছে ভ্রাম্যমান আদালতের ঝটিকা অভিযান

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর তানোরে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছে সার। এমন খবরে ঝটিকা অভিযানে মাঠে মেনেছেন উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি, সদস্য সচিব ছাড়াও বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার (ভূমি)’র ভ্রাম্যমান আদালত। এতে সপ্তার ব্যবধানে পাঁচ ব্যবসায়ীর ২ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়াও ব্যাপক সার জব্দ করে চাষিদের মাঝে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির নির্দেশ দেন ভ্রাম্যমান আদালতে বিচারক।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে গোলো দুই সপ্তার ব্যবধানে রাজশাহীর তানোরে এমওপি (পটাশ) ও টিএসপি সার দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন বিএডিসি ও বিসিআইসি ডিলাররা। তবে, এব্যাপারে বিসিআইসি ডিলাররা বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে আমদানিকারক নোয়াপাড়ার ফায়েজ ট্রেডিং কর্তৃপক্ষের ‘সিন্ডিকেট’কে দায়ী করছেন পাঁচন্দর ইউপির মেসার্স প্রাইম ট্রেডার্সের প্রোপাইটার শ্রী প্রণব কুমার শাহ্।

তানোর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, পুরো উপজেলায় ৯ জন (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) বিসিআইসি ডিলার নিযুক্ত রয়েছেন। এসব ডিলাররা যশোহর নোয়াপাড়ার আমদানীকারক ফায়েজ ট্রেডিং এর মাধ্যমে সব ধরণের সার পেয়ে থাকেন। কিন্তু নোয়াপাড়ার ফায়েজ ট্রেডিং কর্তৃপক্ষ প্রভাবিত হয়ে কালো টাকার গন্ধে সিরিয়াল অজুহাতে চলতি মাসের শুরু থেকে সবধরণের সার সরবরাহে বিলম্বিত করছেন। ফলে সেখান থেকে চলতি মাসে এটুকু সার পাননি ডিলাররা।
এসুযোগে বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) ডিলাররা বরাদ্দের সার নিজেরাই ব্যবহার ও ইচ্ছে মতো বেশি দামে বিক্রি করছেন বলে ভুক্তভোগী কৃষক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর এমওপি সার ছাড়া সব ধরণের সার এ্যাবুলেবুল পাওয়া যাচ্ছে বলে উপসহকারী কৃষি অফিসাররা (বিএস) দাবি করছেন।

এসআর ডিএ ও কৃষি সার্ভিস তথ্যমতে জানা গেছে, পুরো উপজেলার আয়তন ২৯ হাজার ৯০০ হেক্টর। এরমধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমান ২৩ হাজার ৬০০ হেক্টর। বাকি ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর নদ-নদী ছাড়াও খাল-বিল, পুকুর-পুষ্কুনি ও বসতি জমি। এবার গেলো রোপা আমন চাষে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি। অর্জন হয় ২২ হাজার ৪৩৯ হেক্টর। আর চলতি মৌসুমে আলু রোপনে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমি।

এছাড়াও সরিষা চাষে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৬ হাজার ১৭৬ হেক্টর জমি। এসব জমিতে সরকারি হিসেব মতে এমওপি সার বরাদ্দ দেয়া হয় ৫৫৫ মেট্রিনটন। ডিএপি ও টিএসপি ৬৯৪ মেট্রিনটন। আর ইউরিয়া সার ৯২৬ মেট্রিনটন। কিন্তু গম বোপণে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমি। এসব জমিতে গম চাষাবাদে সরকার থেকে বিনামুল্যে ৪০০ মেট্রিকটন বীজ কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।

কৃষি প্রণোদনা বরাদ্দ থেকে সরিষা চাষে ৩৫০ জন চাষীকে ১০ কেজি করে এমওপি এবং ডিএপি সার ও ১ কেজি করে বীজ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। যার দরুণ এমওপি ও ডিএপি সার ৩৫ মেট্রিকটন প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এছাড়াও গম, ভূট্টা, মশুর, খেসারী, পেয়াজ ও সূর্যমুখি চাষেও ১০ কেজি করে এমওপি, ডিএপি সার ও বীজ বিনামূল্যে কৃষকদের মাঝে দেয়া হয়।

তানোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলছে, আলু চাষাবাদে প্রতি বিঘায় এমওপি ৩০ কেজি, ডিএপি বা টিএসপি ২৫ কেজি, ইউরিয়া ৩০ থেকে ৩৫ কেজি সার ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও প্রতিবিঘায় ১ হাজার ২০০ কেজি জৈব সার অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু কৃষক ও মৌসুমী আলুচাষিরা প্রতিবিঘিায় এমওপি ১০০ কেজি, ডিএপি ৫০ কেজি, টিএসপি ৫০ কেজি আর ইউরিয়া সার ৫০ থেকে ৬০ কেজি প্রয়োগ করছেন। এতে সারের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তবে, কৃষকরা বলছেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সূত্রমতে রাসায়নিক সার ব্যবহারে আলুর ফলন অর্ধেকে নেমে আসবে। এছাড়া জৈবসার ব্যবহারে আলুতে রোগ বালাই সৃষ্টি হয়। এতে ফলনও কম হয়।

কৃষকের এমন ভুল ধারণায় কৃষি বিভাগের গবেষকরা বলছেন, কোন অবস্থায় নিয়মের বাইরে এভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা উচিত নয়। রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহারে মাটির উর্বর ক্ষমতা হ্রাস পাই। ফলে কৃষি জমি রক্ষা করতে হলে জৈব সার ব্যবহারে কৃষক মাঠ দিবস ছাড়াও সভা সেমিনার অব্যহত রয়েছে বলে জানান উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনপ্রতিনিধি বলেন সরকারি এতোসব সুযোগ সুবিধা চাষিদের পাইয়ে দিতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ মাঠে সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। কিন্তু সার বিক্রয়ে সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ডিলার, সাব-ডিলার ও নন কার্ডধারী ব্যবসায়ীরা অধিক দামে রাসায়নিক সার বিক্রি করছেন। এতে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। ফলে চলতি আলু, গম ও শরিষা চাষে চরম বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি নিয়মে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) এমওপি সাড়ে ৭শ টাকা, টিএসপি ১১শ, ডিএপি ৮শ ও ইউরিয়া ১১শ টাকায় বিক্রি করার কথা। কিন্তু রাজশাহীর তানোর উপজেলার বিভিন্ন ডিলারের দোকানে, বাজার ও মোড়ে গোপনে তথ্য নিয়ে জানা যায়, দুয়েকজন ছাড়া প্রায় ডিলার ও সার বিক্রেতারা নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন।

এবিষয়ে তানোর পৌর এলাকার জিওল-চাঁদপুর মহল্লার আদর্শ কৃষক ইনছার মন্ডলের পুত্র কাউছার আলী সার বিক্রেতার নাম পরিচয় গোপন রেখে বলেন, তিনি প্রতি বছরের ন্যায় এবারও তাঁর প্রায় ২০ থেকে ২১ বিঘা নিজস্ব জমিতে আলু চাষাবাদ করছেন, ডিলারের কাছে নির্ধারিত দামে চাহিদার তুলনায় কোন সার পাননি তিনি। ফলে নিরুপাই হয়ে, এমওপি (পটাশ) ও টিএসপি সার বস্তা প্রতি ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকায় কিনতে হয়েছে। এভাবে তিনি অর্ধেক জমির সার সংগ্রহ করছেন। বাকি সারের জন্য চিন্তায় আছেন। তবে, তিনি শুধু ডিএপি সার সরকার নির্ধারিত ৮০০ টাকা দামে পেয়েছেন।

একই ধরণের কথা জানিয়ে উপজেলার বেশ কয়েক’শ প্রান্তিক কৃষক জানান, ন্যায্য মূল্যে সার না পেয়ে পরে কাশিম বাজারের বীজ ও কীটনাশক বিক্রেতা বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম, বিএডিসি সার ডিলার আব্দুল মতিন, তানোর বাজারের মাইনুল হাজী, সৈয়ব হাজী, আজগর আলী ও ধানতৈড় মোড়ের জসিম উদ্দিনের দোকান থেকে প্রায় দেড়গুণ দাম দিয়ে সার পেয়েছেন। কিন্তু কৃষক ও মৌসুমী আলুচাষীদের এমন অভিযোগ সঠিক নয় বলে জানান বিএডিসি’র এসব ডিলাররা।

এধরণের অভিযোগে ঝটিকা অভিযানে সপ্তা ধরে মাঠে মেনেছেন উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি, সদস্য সচিব ছাড়াও বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমান আদালত। বিজ্ঞ আদালতের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবিদা সিফাত তালন্দ বাজারে অবস্থিত চৌধুরী ট্রেডার্স বা বালাইনাশক ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম, লাবনী ট্রেডার্সের মালিক গণেশ ও ভাই ভাই এন্টার প্রাইজের মালিক টিপু মন্ডল ছাড়াও আরেক ব্যবসায়ীসহ ৫ জনের ২ লক্ষাধিক টাকা জরিমানা আদায় করেন। এরআগে কামারগাঁ ও আজিজপুর বাজারে অভিযান পরিচালনা করেন উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি ইউএনও।

উপজেলার চাঁন্দুড়িয়া ইউপির জামাল ট্রেডার্সের প্রোপাইটার নুরুজ্জামান জানান, সত্যি কথা কি? বিসিআইসি ডিলাররা তাদের বরাদ্দের ৫০ শতাংশ সার নিজ দোকান থেকে কৃষকের নাম ঠিকানা ও মোবাইল নম্বরসহ মেমো ও রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বেচার কথা। কিন্তু তা না মেনে নন-কার্ডধারীদের কাছে বিনা রসিদে বেশি দামে বেচে দেন। এ জন্যই কৃষকরা বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

এব্যাপারে উপজেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহমদ বলেন, আমদানিকারক নোয়াপাড়ার ফায়েজ ট্রেডিং কর্তৃপক্ষের ‘সিন্ডিকেট সময় মতো সার ডেলিভারী দিচ্ছেন না। এরপরও এমওপি সার সংকট নিরোশনে ও বাজার নিয়ন্ত্রণে ওয়ার্ড পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া আছে। এছাড়াও আমি নিজেও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এসিল্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে বাজার মনিটরিং করে অসাধু ব্যবসায়ী ও ডিলারকে জরিমানায় সর্তক করা হচ্ছে।

উপজেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নিবার্হী অফিসার (ইউএনও) পঙ্কজ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, কৃষকরা যেন ন্যায্য দামে সার পান এজন্য কৃষি অফিসাররা সার্বক্ষণিক মাঠ পর্যবেক্ষণ করছেন। সেইসাথে অসাধু ৫ জন ব্যবসায়ী ও ডিলারের দুই লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করে সর্তক করা হয়েছে। তবে, সারের বাজার নিয়ন্ত্রণে এই অভিযান অব্যহত থাকবে বলে জানান ইউএনও।

জি/আর