তত্ত্বাবধায়ক ফেরাতে রিভিউ’র পরিকল্পনা বিএনপির

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিশ্চয়তা এড়াতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণকে বিচারবিভাগ সমাধান হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন।

এক্ষেত্রে রায়ের রিভিউ করার চিন্তা-ভাবনা স্থির করার পাশাপাশি সংশয় ও দোটানায়ও আছেন বিএনপির আইনজীবীরা। তবে আইনজীবীদের আইনি দিকগুলো খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া। বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও সিনিয়র কয়েকজন আইনবীদের সঙ্গে কথা বলে এই পরিকল্পনার কথা জানা গেছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার (১০ জুলাই) রাতে আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকেও ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের বিষয়টি উঠে আসে। এসময় খালেদা জিয়া আইনজীবীদেরকে রায়ের ফাঁক-ফোকর ও সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন। বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে দলের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে বিএনপির নেতাদের কেউ-কেউ রিভিউ’র কাঙ্ক্ষিত ফল নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ তার যেকোনও রায় তার নিজস্ব ইচ্ছায় অথবা কোনও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনে রিভিউ করতে পারে। এই রিভিউ আবেদন করার পর আপিল বিভাগ প্রাথমিক শুনানি-অন্তে (রিভিউ আবেদনের পর বিচারপতিরা শুনানি করা যায় কিনা, এর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখবেন) যদি রিভিউ করার মতো কোনও আইনগত ভিত্তি পান, তবে শুনানির জন্য আবেদনটি গ্রহণ করে আপিল বিভাগ বিষয়টি শুনানি করতে পারেন।

প্রসঙ্গক্রমে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘রিভিউ করার সুযোগ আছে। সমস্ত রায়ের বিরুদ্ধেই রিভিউ করা যায়।’

রিভিউ করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘চাইলে করা যাবে।’

যদিও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম পুরো বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার প্রশ্ন, ‘সংক্ষুব্ধ হবে কেন?’ তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর রায় রিভিউ করাটা পাগলামি। আমি তো কোনও প্রয়োজন দেখি না। ২০১৪ সালে অলরেডি নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন হওয়ার পর এই চিন্তা পাগলামির চিন্তা।’

বিএনপিপন্থী আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের যুক্তি, ‘‘এই ‘রিভিউ-পাওয়ার’ আমাদের সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এই ক্ষমতা বিভিন্ন মামলার রায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন।’’

সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ এ বলা হয়েছে, ‘আপীল বিভাগ কর্তৃক রায় বা আদেশ পুনর্বিবেচনা: সংসদের যে কোনও আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপীল বিভাগের কোন ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলছেন, ‘কজ তো অলরেডি ইনফ্রাকচার্স হয়ে গেছে। অবজারভেশনে থাকলেও সেটি যদি মেইন জাজমেন্টে না থাকে, তাহলে ইম্প্লিমেন্ট করার স্কোপ নাই। রায়ের পর তো নির্বাচন হয়ে গেছে।’

খন্দকার মাহবুব জবাবে বলেন, ‘যেহেতু এটা অনেক দিন হয়ে গেছে এবং সময়ের লিমিটেশন আছে। আপিল বিভাগ ইচ্ছে করলে সেই লিমিটেশন বাতিল করে রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করতে পারেন।’ এ প্রসঙ্গে আরও উদাহরণ আছে বলেও জানান খন্দকার মাহবুব।

২০১১ সালের ১০ মে শুনানিতে উপস্থিত একজন অ্যামিকিউস কিউরি নিজের নাম ও পরিচয় উদ্ধৃত হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘একটা বিষয় জানা দরকার, রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছিলেন, আগামী দুটো নির্বাচন কেয়ারটেকারের অধীনে হতে পারে। পরে পূর্ণাঙ্গ রায় যখন বের হল, তখন এটা বাদ দেওয়া হল। এরপর আবার বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ওই মামলায় নিজের রায় আলাদাভাবে লিখেছেন, সেখানে ‘আগামী আরও দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হবে’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।’’

এ বিষয়টির সত্যতা জানান খন্দকার মাহবুব হোসেনও। তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্নটিও আসা দরকার। সংক্ষিপ্ত আদেশে যা বলা হল, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে নেই। অথচ আদেশে বলার পর যদি একটি শব্দও বাদ দিতে হয়, তাহলেও পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বসতে হয়।’’

২০১১ সালের ১০ মে ফুলকোর্ট শুনানির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। তবে আদেশের পর্যবেক্ষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলেও মত দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ওই আদেশে আদালত আরও উল্লেখ করেন, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে।

৯০ এর গণ আন্দোলন, এরশাদ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন ও দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে (২৬ মার্চ) ত্রয়োদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়। এর অধীনে তিনটি নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। উচ্চ আদালতের আদেশের পর ২০১১ সালের ৩০ জুন বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্তি ঘটে। সংসদের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে ওইদিন সংসদে বিভক্তি ভোটে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ পাসের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়।

বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ঘোষণা পর থেকেই দলটিতে বিচারবিভাগের প্রতি আস্থা বেড়েছে। এমনকি বিভিন্ন সভায়ও বিচার বিভাগের প্রশংসা ঝরেছে বিএনপির শীর্ষনেতাদের মুখে।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘যেহেতু আদেশে পর্যবেক্ষণ আছে, এ কারণে বিচার বিভাগের ওপর ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ আস্থা যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে না আসবে, যে পর্যন্ত না মনে করব রাজনৈতিকভাবে আদালতকে প্রভাবান্বিত করার সুযোগ নেই, তখনই পুনর্বিবেচনা করতে পারি।’

খন্দকার মাহবুব আরও জানান, ‘দলের মধ্যে আলোচনা আছে। কখনও-কখনও ভাবি। কিন্তু এটাও চিন্তা করি, রিভিউ করতে গিয়ে যদি আপিল বিভাগ বলে দেন, পুনরায় পর্যবেক্ষণের কোনও আইনগত ভিত্তি নেই, তাহলে রাজনৈতিকভাবে যে ইস্যু ব্যবহার করব; সেটা থেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো এবং সেটা থেকে বঞ্চিত হবো। ফলে সংশয় তো রয়েই যাচ্ছে।’

‘এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো তো নিরপেক্ষ হয়নি, এটা তো সবাই জানে। ফলে আদালত দৃষ্টি দিতে পারেন’—বলেও যোগ করেন মাহবুব হোসেন।

এ ব্যাপারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘রিভিউ করার সুযোগ আছে, করতে পারে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বাড়ির মামলার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে, ৭ বছর পর রিভিউ হয়েছে। তবে বিএনপি রিভিউ করবে কি না, এটা এখনও বলা যাচ্ছে না।’

রিভিউ’র সুযোগ আছে বলে জানান বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার আমিনুল হকও।

বিএনপিপন্থী সিনিয়র এক আইনজীবী জানান, ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে রিভিউ চিন্তা-ভাবনা চলছে। এক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদসহ আরও অনেকেই আইনি সহায়তা দিতে এগিয়ে আসবেন। তবে এই তিন আইনজীবীর একজন নিজের নাম ও পরিচয়ে উদ্ধৃত হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বলেন,‘ বিএনপির রিভিউ করা উচিৎ, আরও আগেই করা উচিৎ ছিল। উনাদের গৎবাঁধা ল’ইয়ার দিয়ে হবে না। সাংবিধানিক আইন নিয়ে অভিজ্ঞ কাউকে, যেমন মনজিল মরশিদকে দিয়ে করালে ইফেক্টিভ হবে।’ সিনিয়র এই আইনজীবী যুক্ত করেন, ‘এখন করা উচিৎ।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা তো সরকারের। কিন্তু সরকার তো করবে না। তারা তো চায় না এটা রিভিউ হোক। বাতিল হওয়ায় বর্তমান সরকার খুশি।’

তবে মওদুদ আহমদ জানান, ‘রিভিউ ভবিষ্যতে করা হতে পারে।’

সাবেক এই আইনমন্ত্রী আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ডিলে হবে। কনডোলেশন অব ডিলে হবে। আমার বাড়ির ব্যাপারে যে মামলা, সেটা সরকার ৭ বছর পর আপিল ফাইল করেছে। এটাও রিভিউ করা যাবে। নিশ্চয় রিভিউ ফাইল পিটিশন করা যাবে। সময়সীমা ৩০ দিন হলেও বিলম্বের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা চাওয়া হয়। সেক্ষেত্রে ক্ষমা চাইতে হবে।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন