ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ জানতে চান হাইকোর্ট

ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ না থাকায় সংশ্লিষ্ট পাঁচ জেলার (ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর) জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ডেকেছেন হাইকোর্ট। এসব জেলার অবৈধ ইটভাটার তালিকা নিয়ে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়াল আদালতে তাঁদের যুক্ত থাকতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া বায়ুদূষণ রোধে গত দুই মাস (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রম্যমাণ আদালত কী কাজ করেছেন, তার একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে। বায়ুদূষণসংক্রান্ত চলমান একটি রিটে সম্পূরক আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর এ আদেশ দিয়েছেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে গত ৩০ জানুয়ারি এ আবেদন করা হয়েছিল।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আমাতুল করিম। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী মো. শাহজাহান, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা এবং বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. মনিরুজ্জামান।

আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘কয়েক দিন পরপরই গণমাধ্যমে খবর আসছে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা এক নম্বরে। অথচ ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে। বায়ুদূষণ রোধে কোন কর্তৃপক্ষের কী কাজ এবং কী কাজ তারা করবে আদালতের নির্দেশনায় তা স্পষ্ট করে বলা আছে। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো যদি আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে পদক্ষেপ নিত তাহলে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা হয়তো এতটা ব্যাপকতর হতো না। যে কারণে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে একটি সম্পূরক আবেদন করেছিলাম। আদালত সেটির শুনানি নিয়ে কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে পদক্ষেপ জানতে চেয়েছেন। ঢাকাসহ পাঁচ জেলার জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ডেকেছেন। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁদের ভার্চুয়াল আদালতে সংযুক্ত থাকতে বলেছেন। ’

এই আইনজীবী বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি হওয়ার পর তাদের মতামতের ভিত্তিতে আদালত বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময় আদালত আটবার নির্দেশ দিলেও বিবাদীরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ’

এর আগে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর-প্রতিবেদন যুক্ত করে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে রিট আবেদন করা হয়।

ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে ওই বছর ২৮ জানুয়ারি আদালত রুলসহ আদেশ দেন। ঢাকা শহরে যারা বায়ুদূষণের কারণ সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে দুইবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সেদিন নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া রাজধানীর যেসব জায়গায় উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ চলছে, সেসব জায়গা ওই আদেশের ১৫ দিনের মধ্যে এমনভাবে ঘিরে ফেলতে বলা হয়েছিল, যাতে শুকনো মৌসুমে ধুলো ছড়িয়ে বায়ুদূষণ বাড়তে না পারে। পাশাপাশি ‘ধুলোবালি প্রবণ’ এলাকাগুলোতে দিনে অন্তত দুইবার করে পানি ছিটাতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল।

এসব নির্দেশনার পাশাপাশি আদালত সেদিন রুলও জারি করেছিলেন। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোধে প্রশাসনের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল রুলে। বন ও পরিবেশ সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, নির্বাহী কর্মকর্তা, ডিএমপি কমিশনার, রাজউকের চেয়ারম্যানসহ ১১ বিবাদীকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।

এই আদেশের তিন মাস পর পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন আদালত। ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, আদালত তার একটি প্রতিবেদন চান পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হকের কাছে।

এরপর এক সম্পূরক অবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর হাইকোর্ট ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার বায়ুদূষণ কমাতে অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের জন্য পরিবেশসচিবের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এ ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ এলাকায় যেসব ইটভাটা অবৈধভাবে বা পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে চলছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সেগুলো ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধ করতে বলেন।  প্রয়োজনে অতিরিক্তি লোকবল নিয়োগ করে রাস্তা, ফুটপাথ, ফ্লাইওভার, ওয়াকওভারের যেসব জায়গায় ধুলাবালি, ময়লা বা বর্জ্য-আবর্জনা জমিয়ে রাখা হয় বা জমে থাকে সেসব ধুলাবালি, ময়লা, বর্জ্য-আবর্জনা সাত দিনের মধ্যে সিটি করপোরেশনকে অপসারণ করতে বলেন।

এরপর রিটকারী পক্ষের আরেক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি আরো কয়েকটি নির্দেশনা দেন।

১. যেসব যানবাহন নির্ধারিত মাত্রার বেশি কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে সেগুলো জব্দ করতে হবে।

২. সড়ক পরিবহন আইনের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক যানবাহনের ‘ইকোনমিক লাইফ’ নির্ধারণ এবং যেসব পরিবহনের ‘ইকোনমিক লাইফ’ পেরিয়ে গেছে, সেসব পরিবহন নিষিদ্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া টায়ার পোড়ানো বা ব্যাটারি রিসাইকেলিং বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪. নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জে যেসব অবৈধ ইটভাটা এখনো বন্ধ করা হয়নি, সেগুলা বন্ধ করে দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিতে হবে।

উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশনার পর করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ঢাকার বায়ুমানের কিছুটা উন্নতি হলেও সম্প্রতি ঢাকার বায়ুদূষণ আবারও চরম পর্যায়ে পৌঁছনোর কারণে সম্পূরক আবেদন করে তা নজরে আনার পর ফের আদেশ দিলেন উচ্চ আদালত।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ