ড. শামসুজ্জোহা: ছাত্রদের বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করা মহান শিক্ষক

গোলাম রববিল, রাবি:

‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রদের না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি হায়েনাদের গুলিতে নিহত হওয়ার আগের দিন শিক্ষক সভায় এভাবেই বলেছিলেন তৎকালীন রাবি প্রক্টর।

ঠিক তাই হলো! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তার পরের দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি এই মহান শিক্ষকের বুকে গুলি চালায়। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। বুকের তাজা রক্ত গড়িয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র মাটি লাল হয়ে গিয়েছিল।মৃত্যু নিশ্চিত করতে হিংস্র পশুর মতো বেয়োনেট দিয়ে নৃশংসভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনারা।

বলছিলাম- দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদ শামসুজ্জোহার কথা। ১৯৬৯ সালের এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন তিনি।

এ দিনটি ‍উপলক্ষে শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) ক্যাম্পাসে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহীদ ড. জোহার সমাধি ও জোহা স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পরে সকালের দিকে একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, হল, স্কুল, পেশাজীবী সমিতি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শহীদ ড. জোহার সমাধি ও জোহা স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। বিকেলের দিকে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে দোয়া মাহফিল ও সন্ধ্যায় শহীদ শামসুজ্জোহার হলে প্রদীপ প্রজ্জ্বালন ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করা হয়। কর্মসূচি থেকে এই দিনটিকে জাতীয়ভাবে শিক্ষক দিবস স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সাল। সারাদেশে চলছে পাকিস্তানের স্বৈরশাসন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে ১১ দফা দাবি ঘোষণা করে। পরে ৭ ও ৮ জানুয়ারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রাজনৈতিক ঐক্য ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। ২০ জানুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষনের ঘটনায় নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদুজ্জামান।

১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি। সেদিন সারাদেশে ছিল হরতাল। এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের সরকারবিরোধী আন্দোলন তীব্র এক গণঅভ্যূত্থানে রূপ নেয় । পাকিস্তানি শাসকেরা একে নস্যাৎ করতে আগরতলা মামলা করে। মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যদের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সান্ধ্যআইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান কিশোর মতিউর রহমান মল্লিকসহ চারজন। পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে আটক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করে পাকিস্তান সরকার।

এই ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে থাকেন ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিকসহ সকল শ্রেণির মানুষজন। অবস্থা বেগতিক দেখে তৎকালীন আইয়ুব খান সরকার সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করে। বিভিন্ন জায়গায় সান্ধ্যকালীন আইন ও ১৪৪ ধারা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার।

কিন্তু রাজশাহীতে ১৪৪ ধারা জারি করেও আন্দোলনের ঝড় থামাতে পারলো না। ১৭ ফেব্রুয়ারি কারফিউ ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে পড়ে প্রতিবাদী জনতা ও ছাত্রসমাজ। ড. শামসুজ্জোহা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রক্টর ছিলেন। এসময় শহরে আন্দোলনে গিয়ে সামরিক সেনাদের হাতে আহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। সংবাদ পেয়ে তৎকালীন বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ড. শামসুজ্জোহা। আহত ছাত্রদের অবস্থা দেখে তাদের ভর্তি করেন রাজশাহী মেডিকেলে। পরে মেডিকেল থেকে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে একটি জরুরি সভা ডাকেন ড. জোহা। সেই সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রদের না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’

পরের দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যার প্রতিবাদে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে শহরে যাওয়ার চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে সেই মিছিলে গুলি করার প্রস্তুতি নেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এ খবর শোনামাত্র‌ই সেখানে চলে আসেন প্রক্টর জোহা। নিজের পরিচয় দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গুলি না করার অনুরোধ জানান। সেনা সদস্যরা তার দাবি মানতে অস্বীকার করলে তর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে ড. জোহাকে গুলি করে পাকা হানাদার বাহিনী। পরে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে বর্বর পাক সেনারা। শহীদ শামসুজ্জোহা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। শিক্ষার্থীদের জন্য এরকম নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম‌ই আছে। যারা নিজেদের প্রাণের চেয়ে নিজের শিক্ষার্থীদের জীবনকে বড় দেখেছেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে রুপ নেয়।

শহীদ শামসুজ্জোহার পুরো নাম সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। তার জন্ম ১৯৩৪ সালে ০১ মে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায়। পিতা মুহম্মদ আব্দুর রশীদ পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবেতনভোগী চাকরিজীবী ছিলেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শামসুজ্জোহার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে। বাঁকুড়া জেলা স্কুলে তিনি ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হন। পরে বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণীতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।দেশবিভাগের পর ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে শামসুজ্জোহা তার পরিবার নিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন।

১৯৬৯ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবির সম্মানে ভূষিত করা হয়। তার মৃত্যুর পরপরই তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার নামানুসারে নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরণ করেন “শহীদ শামসুজ্জোহা হল”। শহীদ ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে রাষ্ট্র তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে। তার নামে একটি স্বারক ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে রাষ্ট্র। ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার দিনটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু এখন‌ও পর্যন্ত জাতীয়ভাবে দিনটির কোনো স্বীকৃতি মেলেনি।

জোহা দিবসকে জাতীয়ভাবে শিক্ষক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন। ‘এই উদাসীনতার দায় শিক্ষক সমাজ ও ছাত্র সমাজ সমানুপাতিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও ছাত্র সমাজ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে আন্তঃসম্পর্কে জড়িত থাকলেও জোহা স্যারের আত্মত্যাগের ইতিহাসকে তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি’, বলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ‍ডিজাইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তারিফ হাসান মেহেদি।

মেহেদী আরও বলেন, ‘জোহা স্যারের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ আরো সুগম হয়েছে। তার শহীদ হওয়ার দিনটিকে বারবার শতকণ্ঠে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি করলেও দেশের নীতিনির্ধারকেরা তা কর্ণপাত করেনি। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে তেমন কোন বাঁধা না থাকলেও জাতির এই বীর সন্তানের প্রতি সরকারের উদাসীনতার পরিচয় আমাদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস থেকে হাজার বছর পিছিয়ে দিবে।’ তাই আর কালক্ষেপণ না করে এখনই সময় জোহা স্যারের স্মৃতিকে অম্লান রাখতে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদিকুল ইসলাম সাগর বলেন, ‘তার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলন জোড়ালো হয়। অথচ আজ প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেছে তার আত্মত্যাগের দিনটিকে আজও স্বীকৃতি মেলেনি। এটি আসলে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার জন্য বেদনাদায়ক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছরই এই দিনটিকে শিক্ষক দিবস পালন করা হলেও জাতীয়ভাবে আজও স্বীকৃতি মেলেনি। আজ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের এমন আত্মদান হতো। তবে এতো কালক্ষেপণ না করে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এইদিনটিকে আজ স্বীকৃতি দেওয়া হচে্ছনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি না আসলে কারো কোনো টনক নড়ে না।  এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ‍শিক্ষক সমিতি যদি একত্রে কাজ করে তবে খুব দ্রুতই এই দিবসটির স্বীকৃতি মিলবে। এছাড়াও, দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জোহা স্যারের আত্মত্যাগের কথা ছড়িয়ে দিতে হবে।’

জাতীয় শিক্ষক দিবস প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আসাবুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দাবি উত্থাপন করবে। পাশাপাশি ‍বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনে এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতি কথা বলবে। বাংলাদেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি বলে জানান তিনি।

এএইচ/এস