ড.জেকিল ও মি. হাইড এবং আমাদের ঐশী


মোঃ কায়ছার আলী :
‘‘ রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায়গো লয়, আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়।” কবি এখানে বলেছেন মানুষ কর্মের দ্বারা এ পৃথিবীতে স্বর্গীয় সুখ বা নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। রিপুর তাড়না মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বিবেকহীন করে তোলে। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে শক্তিমান লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসন এর লেখা (১৮৮৬ সালে রচিত) ড. জেকিল ও মি.হাইড গল্পখানা পড়েছিলাম।

তাঁর রচনার প্রসাদগুণ এমনই অভিনব, এমনই মৌলিক, এমনই স্বত:স্ফুর্ত ও প্রাণবন্ত যে আমরা লেখকের নাম ভুলে গেলেও শুধু মনে রাখি তাঁদের লেখার বা সৃষ্ট চরিত্রের কথা। তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি ড.জেকিল ও মি.হাইডের রহস্যময় কাহিনী। অভূতপূর্ব কল্পনাশক্তি, ঘটনার নাটকীয়তা, চরিত্র নির্মাণের উজ্জ্বলতা সর্বোপরি বিস্ময়কর রকমের এমনি মৌলিক কাহিনী সৃজনশীল লেখকদের হাতে খুব কমই রচিত হয়েছে। এই গল্পের লোভনীয় কাহিনী, চমৎকার আঁটসাঁট বাঁধুনি, জাদুকরি ভাষা এবং অসাধারণ বক্তব্য পাঠকদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে যুগের পর যুগ। এই গল্পে ভালো ও মন্দের সংঘাত দেখানো হয়েছে। সেই সংঘাতে ভালো ও মন্দের মধ্যে কে জয়লাভ করেছে- সে প্রশ্ন পাঠকদের কাছে। ড. জেকিল একজন সম্মানিত এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব (মাদক সেবন করে) রুপান্তরিত হয়ে তিনি মি.হাইড এ পরিণত হন। হাইড অসৎ , খুনি, কুৎসিত এক ব্যক্তি। হাইডের মাধ্যমেই মানুষের ভিন্ন সত্তার উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিপুল ঐশ্বর্য ও দারুন সৌভাগ্য নিয়ে ড.জেকিল জন্মগ্রহণ করেন।

শুধু অর্থ নয়, চারিত্রিক সৎ গুণাবলী, পরিশ্রমী, জ্ঞানী গুনীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, জ্ঞান আহরনের প্রতি চরম দুর্বলতা অর্থাৎ সব মিলিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিশাল সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব। তবে দোষ ত্রুটির মধ্যে ছিল উদ্দাম আমোদ-প্রমোদের প্রতি তীব্র আকর্ষন, দশজনের মধ্যে একজন হবার দুর্বার আকাক্সক্ষা, মাথা উচুঁ করে চলার শক্তি আর অন্যদিকে নিষিদ্ধ বা অসামাজিক কর্মের প্রতি মোহ। দুয়ের মধ্যে কখনো ঐক্য সম্ভব নয় তাই মনের প্রতি অযাচিত চাঞ্চল্য ও আমোদ, প্রিয়তাকে বিসর্জন দিয়ে এক ধরণের কপট গাম্ভীর্য নিয়ে তিনি চলাফেরা করতেন এবং দ্বৈত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। উঁচু মানের জীবনপদ্ধতি, ছোটখাটো উচ্ছ্বাস ও আনন্দের ব্যাপারগুলো লজ্জার তাড়নায় লুকাতে শুরু করলেন। দোষগুলো তেমন মারাত্মক কিছু না হলেও তার উচ্চাকাক্সক্ষা তাকে লাজুক করে তুলল এবং তার বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানসাধনা ও গবেষণা, গুপ্ত রহস্য ও অতি প্রাকৃত শক্তি রহস্য উন্মোচনে কাজ করতে লাগল। অতি মাত্রায় অর্জিত জ্ঞানই ছিল অধঃপতনের মূল কারণ। তিনি বুদ্ধিমত্তা ও নৈতিকতা দিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, মানুষের সত্তা আসলে একক নয়, দ্বৈত। প্রতিটি মানুষ অনেকগুলো স্বাধীন ব্যক্তিত্বের সমষ্টি। তার আবিষ্কৃত একটা মাদক ওষুধ পান করা মাত্রই মানসিক ও শারীরিক বিপর্যয় দ্রুত ঘটে অন্য এক সত্তায় পরিণত হয়। ড.জেকিলের তুলনায় হাইড ছিল ছোট ও অল্প বয়স্ক। মুখের পবিত্র ভাব পরিবর্তন হয়ে শয়তানীর ছাপে পরিণত হত। হাইডের কুৎসিত মুখ ছিল পুরোটাই মন্দ।

নতুন রকমের রোমাঞ্চ অনুভব করে শরীরের হালকা অনুভূতি নিয়ে ড.হেনরি জেকিলের স্থলে পাপিষ্ট এডওয়ার্ড হাইডের আর্বিভাব ঘটিয়ে মজার খেলা খেলত। প্রকৃত পক্ষে হাইডের কোন অস্তিত্ব বাস্তবে ছিল না। কেবল রসায়নাগারে ওষুধটা পান করে হাইড অদৃশ্য হয়ে যেতেন এবং তার স্থানে এসে যেতেন সম্মানিত ও সকলের শ্রদ্ধেয় ড.হেনরি জেকিল। অত্যন্ত গোপনে ও সতর্কভাবে তিনি বিজ্ঞানাগারে এই ওষুধ সেবনের মাধ্যমে অসম্ভব কাজগুলো করতেন। হাইডের অপকারী দুর্বৃত্ত, নির্দয়, পশুবৃত্তি ও পাপাচারের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতেন ড.জেকিল। ঘন ঘন ওষুধ পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে ড.জেকিলের ভালো সত্তা হারিয়ে গিয়ে হাইডের সত্তার কাছে পরাজিত হল। অবশেষে নিজের ভিতরে দুর্দম পশুকে আর বন্দী করে রাখতে পারলেন না। বেরিয়ে এল ক্ষুব্ধ গর্জনে হিংস্র নিষ্ঠুর আচরণ। মানুষকে পিটিয়ে খুন করে নারকীয় উল্লাস করে সর্বোপরি মহা সর্বনাশ করে চলতে লাগল। ভি.আই.পি খুনের অপরাধে ফাঁসি হতে বাধ্য মি.হাইড তখন নিরাশ্রয় এবং ফেরারি আসামি। পরবর্তীতে হাইডকে পাপের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। আশ্চর্যজনক দ্বৈত চরিত্র বিলীন হয়ে রয়েছে একটি চরিত্রের মধ্যে।

সম্মানিত পাঠকেরা বুঝতে পেরেছেন এই কাহিনীর সারমর্ম। প্রতিটি মানুষের চরিত্র ও ব্যবহারের পরিবর্তন হয়। প্রতিটি মানুষ অনেক সত্তায় গঠিত। যেমন- আপনি কারও পিতা, কারও সন্তান, কারও শিক্ষক, কারও ছাত্র, কারও প্রিয়, কারও অপ্রিয়, ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় একবার এক লেখকের খুব ইচ্ছা জাগে পৃথিবীতে নিষ্পাপ মানুষের ছবি তুলে প্রচার করবে।তিনি নিষ্পাপ মানুষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। নিষ্পাপ, নিরপরাধ, নির্দোষ, মানুষ এই সমাজে খুঁেজ পাওয়া কঠিন। তখন তিনি ভাবলেন শিশু ছাড়া নিরপরাধ কেউ নয়। ফটোগ্রাফার নিয়ে ছবি তোলার আগে শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করল “বাবু তুমি কি কি খাবে”? শিশুটি বলল,“আপেল, চকলেট, চিপস ইত্যাদি”। লেখক শিশুটির ছবি তুলে হাজার হাজার কপি নিরপরাধ, নিষ্পাপ মানুষের বলে বিক্রি করলেন। প্রায় কুড়ি বছর পর কৌতুহলী লেখক এবার একজন পাপী, অপরাধী, দোষী লোকের সন্ধান করতে লাগলেন তখন লোকেরা বললেন, রেল স্টেশনের ধারে ঐ যে যুবকটি ঘুমন্ত ও অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে সেই পাপী। নেশার টানে ঐ যুবকটি পৃথিবীতে পারে না এমন কোন খারাপ কাজ নেই। ঘুম থেকে উঠে বা চেতনা ফিরে পাওয়ার পর লেখক ঐ যুবককে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি কি খাবে?” অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত যুবকটি বলে, মদ, হিরোইন, ইয়াবা ইত্যাদি। লেখক ফটোগ্রাফারকে ডেকে নিয়ে এসে ছবি তুলতে চাইলে ফটোগ্রাফার বলেন, স্যার! আজ যার ছবি তুলছি সে হল ঐ শিশুটি যাকে আপনি নিষ্পাপের প্রতীক মনে করে প্রচার করেছিলেন আর আমি ছবি তুলেছিলাম।

ফটোগ্রাফার যুবকটির পূর্বপরিচয় জানতেন তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন। দুর্ভাগ্য বা শিক্ষা বা বৈরী পরিবেশে, ঘুনে ধরা সমাজে, হাতের কাছে মাদকের অবাধ বিস্তারে একসময়ের নিষ্পাপ শিশু পাপী যুবকে পরিণত। লেখক এই পাপী যুবকটির ছবি তুলে হাজার হাজার কপি বিক্রি করলেন। নীতি-নৈতিকতা, বিবেক, মূল্যবোধ না থাকায় অথবা রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভে সারা পৃথিবীতে আজ মাদকের অবাধ বিস্তার ঘটেছে। এখন আমরা খুবই একটা জটিল সময় অতিক্রম করছি। ১৮ই আগস্ট ২০১৩ ঢাকার চামেলীবাগের পুলিশ দম্পতির খুনের ঘটনা কে না জানে? হত্যাকান্ডের আগে চেতনানাশক ঔষধ কৌশলে খাইয়ে দিয়ে নির্মম, নির্দয়, জঘন্য ও আলোচিত হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে তাদেরই ঔরসজাত মেয়ে ঐশী। পিতা-মাতার কাছে একসময়ের ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু ঐশী (সুন্দর নাম) আজ সকলের কাছে খুনী, অপরাধী ও মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত নামটি (মীরজাফরের মত)। একটা খারাপ চেতনার উদাহরণ। এর জন্য কি পুরোপুরি বা শতভাগ ঐশীই দায়ী? অত্যন্ত আধুনিক করে যারা তাকে তৈরী করতে চেয়েছিলেন, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে তারা কি সাধু- সাধ্বী? টিন এজ বা কিশোর-কিশোরী বয়সে (হতে পারে আঠারোর কম বা বেশি) ঐশী যদি মাসে স্বেচ্ছায় হাত খরচ বাবদ এক লাখ টাকা পেয়ে থাকে তবে তা আশ্চর্যের বিষয়।

যারা তাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দিলেন তাদের কি খোঁজ খবর নেওয়া উচিত ছিল না। ঐ টাকা কি কাজে ব্যবহার হচ্ছে ? বাবা-মা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কেন উদাসীনতার পরিচয় দিলেন? সে প্রশ্ন আজ কে করবেন? কাদের সঙ্গে মেলামেশা ছিল সেটা কি খোঁজ খবর নেওয়া অভিভাবকদের উচিত ছিল না? আর যখন খোঁজ খবর নিয়েছেন তখন সব শেষ অর্থ্যাৎ পুড়ে ছাই ভস্ম হয়ে গেছে। ঐশী তখন ড.জেকিল থেকে মি. হাইডে পরিণত হয়ে গেছে। ঐশীর বয়ফ্রেন্ড ছিল পনের জন। কোন দিন বাসায় ফিরত, কোন দিন ফিরত না। বিভিন্ন প্রকার মাদক দ্রব্য এবং ইয়াবা নিয়মিত খেত। টুইন টাওয়ারে ডিজে ক্লাবে নিয়মিত যেত। অনেক দেরীতে তার বখাটেপনায় বাঁধা দেওয়া হয়। কারফিউ জারির মত কড়াকড়ি শাসন, টাকা-পয়সা দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। জীবন ও যৌবনের সমস্ত সর্বনাশ ঘটে যাওয়ার পর কি আর পিছনে ফিরে যাওয়া সম্ভব? নদীর স্রোত এবং সময়ের গতি কখনো উল্টো পথে যায় না। সহজ কথায় বলা যায়, সূঁচের ভিতরে দিয়ে হাতি প্রবেশের মতো অসম্ভব। ভেবে আশ্চর্যান্বিত অবাক হই অত্যন্ত মেধাবী ঐশী তৃতীয় শ্রেনী থেকে ডায়েরী লিখত। কি লিখত জানি না। তবে ডায়েরীতে সর্বদা ভালো কিছু লেখা উচিত। কারণ সেটা পরবর্তী প্রজম্মের কাছে একটা বার্তা বহন করে। ঐশীর বয়সের মত একবার এক ছাত্রী প্রাইভেট টিউটরের কাছে প্রেম পত্রের উত্তর লিখে চাইলে গৃহশিক্ষক বলেন, বেয়াদব মেয়ে তোমার বাবা-মার কাছে এই বিষয়ে নালিশ করব। মেয়েটি উত্তরে বলে, স্যার নালিশ করে লাভ নেই। আমার বাবা-মার ডায়েরী পড়ে দেখেছি তারা প্রেম বা আর কি কি করেছে। সুতরাং এমন পিতা-মাতা কি নৈতিক অধিকার রাখে সন্তানকে শাসন করার? তাহলে নিরপরাধ সন্তান কার কাছে ভাল কিছু শিখবে? ঐশী হয়তো পরিবারে ভালো কিছু শিখতে পারেনি। তাই সে আজ দন্ডিত অপরাধী। নিম্ন আদালতে ফাঁসির রায় হওয়ার পর জেলখানায় থাকা সেখানকার আশপাশের লোকেরা তার দিকে বাঁকা বা তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাবে, কেউবা বলবে পিতা-মাতার খুনী, কেউবা ধিক্কার জানাবে।

ফুলের মত নিষ্পাপ মুখ খানি আজ কলঙ্কের কালিমায় লিপ্ত। ঐশীকে মাদকাসক্ত করতে যারা আজ নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে তারা আজ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে আরো ঐশী তৈরী হবে। আর যেন ঐশী তৈরী না হয় এমন আর্তনাদ জানাই সকলের কাছে। নিকট ভবিষ্যত বলে দিবে ঐশীর আইনের অবশিষ্ট প্রক্রিয়া (উচ্চ আদালতে চলমান এবং মহামান্য রাষ্টপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন)। পরিশেষে সকলকে এ নৃশংস ও হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনুরোধ করছি।

পিতা-মাতা সর্বদাই সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। কাজেই তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অন্যায় পথে যাওয়া কোন সন্তানের উচিত নয়। চেতন বা অবচেতন মনে অন্যায় করে বা বিপদে পড়লে যারা আশ্রয় দেয় সেই পিতৃকোল বা মাতৃক্রোড় আজ ঐশীর নেই। সে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছে পৃথিবীর পরিবেশ কতটা বৈরী এবং আইনের শাসন কতটা শক্তিশালী। মানুষ পরিবার পরিজন ছাড়া অন্যের কাছে কতটা অসহায়। নেশাগ্রস্ত ঐশীর শাস্তি আজ নেশাহীন ঐশী ভোগ করছে, করতেই থাকবে। আইনের দৃষ্টিতে দন্ডিত, খুনি, অপরাধী, সমাজে ঘৃনিত বা অন্যায়কারী ঐশীর বাবা-মার অবিনশ্বর আত্মা এরপরেও ঐ দুর থেকে এখন কি চাইছে বা ভাবছে তা আমি জানি না।