ডিলানকে চেনেন, লালন ফকিরকে চেনেন তো?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল জিততে পারেন, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না বাংলার সেই মহান কবি ও সাধকের কথা যিনি অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন।

 

বব ডিলানকে ‘আমেরিকার সংগীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক ব্যাঞ্জনা সৃষ্টির’ জন্য ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য সমাজ যথার্থ অর্থেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের মতামত আমরা আমাদের স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে এবং অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় পড়েছি। আমাদের এই সময়টা মৌলিকভাবে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। প্রযুক্তির সাথে আমাদের যে সম্পর্ক তা আমাদের আধুনিক জীবনের অপরিহার্য অংশ। তাই এটা একেবারেই আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু না যে ডিলানের ‘টাইমস দে আর আ চেঞ্জিং’ এর অনুভূতি আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখবে।

 

ডিলানকে পুরস্কার দেওয়ার মধ্যে দিয়ে নোবেল কমিটি কেবল ‘সাহিত্য কী’ এটা নিয়েই প্রশ্ন তোলেনি বরং কথাটির অর্থ এবং প্রাসঙ্গিকতাকেও সম্প্রসারিত করেছে। এই ধরনের সম্প্রসারণে অনেকে সংশয়ী ও বিস্মিত হয়ে পড়েছে। তবে চিত্রনাট্য, কৌতুক অভিনয়, সেইসাথে টুইটকেও সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা যাবে কি না?

 

এটা আমাকেও বিস্ময়ের মধ্যে রেখেছে যে, শিল্পীর কাজের উপস্থাপনার ভঙ্গিকেও সাহিত্যকর্ম বিচারের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হবে কি? সাহিত্য উৎসবগুলোও এক প্রকার পরিবেশনা- যেখানে সবার সামনে দর্শকের সুবিধার জন্য মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মুখচোরা লেখক যে কি না জনসম্পৃক্ততা অপছন্দ করেন, ইতিমধ্যে তাদের পতন ঘটতে শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ লেখককে সাহিত্য সমাবেশে পারফর্ম করার আগে কীভাবে তারা কথা বলবেন এবং হাসবেন অথবা ভ্রু কুঁচকাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রস্তুতি নিতে হয়। সেইসাথে সঠিক শব্দটি নির্বাচন, শরীরী ভাষাকে যাচাই করা, অঙ্গভঙ্গি, পোশাক নির্বাচন, স্বর, কথা বলার রীতি এবং আরো অনেককিছু। শোনা এবং দেখার দৃষ্টিভঙ্গী শব্দের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। দৃশ্যকল্প বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে, কখনো কখনো শিল্পের চেয়েও বেশি।

 

যারা কি না শিল্পের জন্য অপরিহার্য নিঃসঙ্গতাকে ভালোভাসে। সেই শিল্পীকেও এখন সাধারণের জন্য পারফর্মেন্স আর্টিস্টে পরিণত হতে হচ্ছে। একমাত্র তারাই যারা কি না ওই ধরনের পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, আপনাকে বলতে পারবেন কী ধরনের আতঙ্ক এবং স্নায়ুচাপের সম্মুখীন হতে হয়েছিল সে সম্পর্কে।

 

বর্তমান পৃথিবীতে মঞ্চ পরিবেশনা এবং জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে লেখক থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী সংগঠন, সবার জন্য জনসংযোগ সংস্থাগুলোকে ভাড়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

জনসংযোগ সংস্থা আপনাকে যা দিবে তা শিল্প আপনাকে কদাচিৎই দিতে পারবে। ইন্টারনেটে দৃশ্যের বাস্তবতার গুরুত্ব প্রকৃত বাস্তবতার চেয়ে একটুও কম নয়।

 

উপস্থাপনার মূল্যায়ন

অমিতাভ ঘোষকে নিয়ে করা একটি অনুষ্ঠানে লক্ষ করেছিলাম, লোকজন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। সেটি বইয়ে তার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য না বরং লেখকের সাথে সেলফি তোলার জন্য। শ্রীমান ঘোষের সাথে ছবি তোলে তাৎক্ষণিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে দেওয়া হচ্ছিল। এমনকি সেলফি প্রত্যাশির হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া, ঘোষের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে শক্তিমান ও দরকারি গদ্যের চেয়ে বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

 

প্রত্যেকে চায় নিজের আলাদা ভাবমূর্তি তৈরি করতে। যেমন পরিবেশ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপস্থাপনার সাথে বিনোদনমূলক মান যুক্ত করে, মৌলিক চিন্তা এবং তার ক্রিয়ার ফলাফলের ওপর প্রভাব বিস্তার করা। রাজনীতিবদরা এই বিষয়টি অন্য যে কারো চেয়ে বেশি জানেন, যেহেতু তাঁরা জনগণের মাঝে একটা নির্দিষ্ট দীর্ঘস্থায়ী কল্পমূর্তি সৃষ্টি করে সেটা ধরে রাখতে চান। প্রচ্ছন্নভাবে একইসাথে সরাসরিও অস্বস্তিকর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করাকে নিরুৎসাহিত এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে কারো জন্য নিজেকে প্রকাশ করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে; এমনকি গণতান্ত্রিক সমাজেও যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মূল্য দেওয়া হয় বলে ভাবা হয়। সেসব লোক যারা রাষ্ট্রের তৈরি আখ্যান অনুসারে আচরণ করেনা তাদের ‘জাতি বিরোধী’ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাসী ‘ এবং ‘ষড়যন্ত্রকারী তাত্ত্বিক’ বলে ডাকা হয়।

 

আমাদের সময়ের একটা সহজাত প্রবণতা হলো নোবেল বিজয়ী কোনো সাহিত্যকে কাজের জন্য পছন্দ করা হলে, শিল্পীর উপস্থাপনার গুণ বিবেচনা করা হয়, যেটা হয়তো অনেকেই পছন্দ করতে পারে আবার নাও করতে পারে।

 

তবুও আমি এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই কেননা, এটি আমাদেরকে সাহিত্য এবং আমাদের এই পৃথিবী সম্পর্কে ভাবতে উৎসাহিত করেছে। আমরা এখন বুঝতে পারি যে, লোক সংগীতের কাব্যময় উপস্থাপনাই মূলত সাহিত্যের আদি উৎসটি গঠন করেছে- এবং এটি খুব যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত, প্রাচীন অলিখিত লোক সংস্কৃতির সাথে ৬০ ও ৭০ দশকের ইতিহাস এবং আমাদের সমাজের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে সাহিত্য ভাবনার আদলে উপস্থাপন করা।

 

উপরে উল্লেখিত বক্তব্য অনুসারে, আমি আশা করব যে এই সিদ্ধান্তটি নোবেল সংস্কৃতির ব্যতিক্রম কিছু হয়ে থাকবে না, বরং নতুন স্বাভাবিক কিছুর দিকে যাত্রা হিসেবে বিবেচিত হবে। বাজিকররা অবশ্য সামনের দিনগুলোতে লিওনার্দো কোহেন এবং গুলজারকে নিয়ে বাজি ধরতে পারে। কিন্তু আমি আরো আশা করব একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমরা লেখক, কবি, নাট্যকার এবং এমনকি দার্শনিদের কাছে ফিরে যাব। সে সময় পর্যন্ত, যতক্ষণ না সমাজে নতুন কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের প্রয়োজন পড়ছে।

 

লালন ফকির

রবার্ট জিমারম্যান যিনি বব ডিলান নামে অধিক পরিচিত। ডিলান তাঁর নামটি নিয়েছেন কবি ডিলান টমাসের নাম থেকে। বাংলার আধ্যাত্মিক বাউল সংস্কৃতির সাথে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ডিলানের এলবাম ‘জন’স ওয়েসলি হার্ডিং’-এর কাভারে পূর্ণদাশ বাউল এবং লক্ষণদাশ বাউলের ছবি সহযোগে আলাদা বিশেষত্ব পেয়েছিল। এমনকি পূর্ণদাশ বাউলের ছেলের বিয়েতেও ডিলান নিজে কলকাতা এসেছিলেন।

 

বাংলার বাউল সংস্কৃতি হলো লোক গানের মধ্য দিয়ে কাব্যিক অভিব্যক্তি প্রকাশের সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতির সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠ সন্দেহাতীতভাবে লালন ফকির। যিনি উনিশ শতকে বেঙ্গল রেঁনেসাসের অংশ, যখন আধুনিকতা ও নতুন চিন্তা বাঙালি সমাজে প্রবেশ করছিল। লালন জন্মগ্রহণ করেন কুষ্টিয়ায় (যা এখন বাংলাদেশের অংশ)। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা ছিল না এবং তিনি দীর্ঘজীবন দারিদ্র্যের মধ্যে কাটিয়েছেন। লালনের গানগুলো ছিল আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যা তিনি দরিদ্র চাষিদের উদ্দেশে গাইতেন। তাঁর খ্যাতি বৃদ্ধির সাথে সাথে, লালন অনেক কবিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। যাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এলেন গিনসবার্গের মতো কবিও আছেন। তিনি ছিলেন মরমী সাধক, গীতিকার, গায়ক, সমাজ সংস্কারক ও চিন্তক। কিন্তু তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস ছিল তাঁর নিজের জীবনাচরণ, কোনো দর্শন বা সাহিত্যিক মতবাদ নয়।

 

লালন হাজারখানেক- ২০০০ হাজার থেকে ৮০০০ এর মধ্যে হবে- গান রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই গানগুলোর কোনো লিখিত রূপ ছিল না। এগুলো প্রধানত তাঁর গ্রামীণ শিষ্যদের মধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল; যাঁরা ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন এবং এই কাজগুলো প্রতিলিপি করতে অক্ষম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের কিছু কাব্যিক অভিব্যক্তির কথা লোকগীতি কলকাতার মাসিক ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন।

 

কিন্তু আজকের দুনিয়ায় লালনের গানের প্রতি আগ্রহ তৈরির ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে সাহায্য করছে। অনেক সাইট আছে যেখানে লালনের বিস্ময়করভাবে জটিল রহস্যময় কবিতা/গীতগুলো বাংলায় পড়া যেতে পারে এবং এমনকি ইউটিউবে অন্যদের মাধ্যমে গাওয়া তার গানগুলো শোনা যেতে পারে।

 

লালন নিয়ে একাডেমিকভাবেও আগ্রহের ঢেউ উঠেছে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্কলাররা তাঁর কাজগুলো নিয়ে নানা ধরনের আর্টিকেল রচনা করছেন যা ইংরেজিতেও অনুবাদ করা হচ্ছে।

সূত্র: এনটিভি