ডিজিটাল যুগেও টিকে আছে ডাক

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

৯ অক্টোবর  বিশ্ব  ডাক দিবস। ১৮৭৪ সালে ৯ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের বার্নে ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়ন নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করা হয়েছিল। সংক্ষেপে একে ইউপিইউ বলে থাকে। ১৯৬৯ সালে ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়ন কর্তৃক জাপানের টোকিওতে একটি কংগ্রেসে সেই ৯ অক্টোবরকে বিশ্ব ডাক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে তা পালন করা হয়ে আসছে। বিশ্ব ডাক দিবস পালনের একটি গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১৫০টিরও অধিকরাষ্ট্র একসাথে একই দিনে দিবসটি পালন করে।

 

আমাদের সবারই মনে থাকার কথা, মাত্র কয়েকদিন আগে একটি চিঠি সারা দেশে টক অব কান্ট্রি ছিল। আর সে চিঠিটি ছিল পটুয়াখালী জেলার এক অজপাড়াগাঁয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের, যে কি না পটুয়াখালী শহরের একটি সরকারি স্কুলে পড়ছে। অসীম সাহসী সেই ছেলেটির নাম শীর্ষেন্দু বিশ্বাস। সেই চিঠিতে ছাত্রটি তার স্কুলে যাওয়ার পথে মির্জাগঞ্জে পায়রা নদীর উপর দিয়ে নৌকাডুবিসহ অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এসব দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সে পত্রটি লিখে মায়ের সহায়তায় তা ডাক বিভাগের মাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছিল। তারপর বাংলাদেশের জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর একটি ছোট্ট ছেলের পত্রের বিষয়বস্তুর প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পত্রটিকে আমলে নিয়ে সেই ছেলেকে পুনরায় ব্রিজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উক্ত পত্রের উত্তর দেন ডাক বিভাগের মাধ্যমে। কাজেই ডাক বিভাগের মাধ্যমে এ ডিজিটাল যুগেও অজপাড়াগাঁয়ের একটি বাচ্চা ছেলের সাথে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সংযোগ স্থাপন করতে পারে। কী তার শক্তি।

 

আমি নিজে আমার জীবনের প্রথম চিঠি লিখে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে। আমি কিশোরগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ের একটি অঞ্চল থেকে ঢাকায় থাকা চাচার নিকট চিঠি লিখেছিলাম। সেই চিঠিটি ছিল চাচার নিকট একটি ফাউন্টেনপেন কলম চেয়ে। আমি অবশ্য গোপনে নিজে নিজেই সেই চিঠিটা লিখে পয়সার অভাবে সেদিন (মাত্র ৫০ পয়সা সাথে না থাকার কারণে) বিয়ারিং চিঠি পোস্ট করেছিলাম। বিয়ারিং চিঠি লেখার নিয়ম হলো টাকা পয়সা ছাড়াই চিঠিটা বাকিতে যেকোনো খামে পোস্ট করে পাঠানো যাবে, তবে প্রাপককে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে  চিঠিটা পোস্ট ম্যানের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হতো। একটি চিঠি যে একজন মানুষের জন্য কতটুকু আকাঙ্ক্ষিত তা যিনি এর সুফলভোগী তিনিই অনুভব করতে পারেন। একজন চাকরি প্রার্থীর কাছে একটি ইন্টারভিউ কার্ড পাওয়ার জন্য সেই পোস্ট অফিসের পোস্টম্যানের দিকে তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকা। তারপর সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে একটি সোনার হরিণখ্যাত চাকরি পেলে সেই চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার সে যে কী অপেক্ষা আনন্দ, আর না পাওয়ার কী বেদনা!

 

ছোটবেলায় কিছু বন্ধুদের সাথে পেনফ্রেন্ড করতাম। একটি চিঠি লিখে আবার তার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত মনটা আনচান করত। কেউ বিদেশের স্কলারশিপের জন্য চিঠি আদান-প্রদান, কারো ছেলে-মেয়ে, কিংবা বাবা-মা অথবা আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে চিঠি আদান প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। অপরদিকে সবচেয়ে গুরুত্বপর্ণ চিঠি হলো বাবা-মায়ের কাছে দেশ-বিদেশের দূরে থাকা সন্তান-সন্তুতির। প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে চিঠি আদান-প্রদান। কিন্তু এগুলো সবই এখন ডিজিটাল ব্যবস্থার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সেগুলোর ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

 

টেলিফোন ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধিত হওয়ার পর থেকে পত্র লেখার চাহিদা কমতে শুরু করেছে। তার উপর এখন অতি সহজলভ্য সবার হাতে হাতে আধুনিক মোবাইল সেট ও ফোনের মাধ্যমে এসএমএস, এমএমএস, ইন্টারনেটের কল্যাণে ইমেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদিও মাধ্যমে এখন চাইলেই নিমিষে দেশ-বিদেশে আঙ্গুলের ইশারায় যোগাযোগ করা যাচ্ছে। তা ছাড়া ডাক বিভাগের কিছু দুর্বলতার সুযোগে এখন এর বাজার কুরিয়ার সার্ভিস দখল করে ফেলেছে। কিন্তু এত সব সহজ সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি কাজের জন্য এবং বিশ্বস্ততার জন্য ডাক বিভাগের বিকল্প নেই। ইদানীং ডাক বিভাগ তার নির্ধরিত কাজের বাইরেও ব্যাংকিংনহ নানা আর্থিক বিষয় নিয়ে জনকল্যাণে সেবামূলক কাজ করছে। এখন ডাক বিভাগকেও আগের তুলনায় অনেক যুগোপযোগী করে ডিজিটাল করা হচ্ছে। তবে বর্তমানের ধারায় আরো উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে।

 

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: এনটিভি