ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগে আলোচনার তাগিদ সাংবাদিক নেতাদের

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সাংবাদিকদের মতামত ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন না করার দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। তারা বলছেন, সাংবাদিকদের মতামত ছাড়া গণমাধ্যম সম্পর্কিত কোনও আইন করা হলে প্রশাসন বা সরকারের সঙ্গে সাংবাদিকদের দূরত্ব বাড়বে। গণমাধ্যমকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে চেতনা, তেমন উদ্যোগ সেই চেতনারও পরিপন্থী হবে। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের আগে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া গণমাধ্যম সম্পর্কিত কোনও আইন করা যাবে না। প্রসঙ্গ: ৫৭ ধারা বাতিল বা নতুন চেহারায় প্রতিস্থাপন।’ নতুন আইন করতে গেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কেন আলোচনা করতে হবে জানতে চাইলে সিনিয়র এই সাংবাদিক বলেন, ‘সাংবাদিকদের সঙ্গে এ জন্য আলোচনা করা প্রয়োজন, যখন আইসিটি আইন করা হয়, তখন আমাদের বলা হয়েছিল ৫৭ ধারাটি শুধু সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু পরে আমরা দেখেছি, এই ধারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। কাজেই আমরা কোনও আইনে এমন কোনও ধারা রাখতে চাই না, যে ধারা সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগের হতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি এ কথা বলতে চাই না যে, সাংবাদিকরা অপরাধ করলে তাদের ধরা যাবে না। অবশ্যই ধরা যাবে। কিন্তু ৫৭ ধারার মতো একটা বাজে আইনের মাধ্যমে যেভাবে সাংবাদিকদের অপদস্ত করা হয়েছে এমন কোনও আইন আমরা চাই না। আমাদের এ না চাওয়াটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণমাধ্যমকে মর্যাদা দেওয়ার যে চেতনা সেটার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমাদের দেশে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারায় আগে মানহানির মামলা হলেই সাংবাদিকদের অ্যারেস্ট করা হতো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, মানহানি মামলা হলেই সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা যাবে না। সমন জারি হবে। তারা কোর্টে হাজির হবেন। তখন যদি মামলার তথ্য-উপাত্তে দেখা যায় যে, তারা অপরাধ করেছেন, তাহলে মামলা চলবে। সাংবাদিক একটি লেখা লিখলো, সেটার বিরুদ্ধে একটা মানহানি মামলা হলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে অফিস থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। এটা থেকে প্রধানমন্ত্রী আমাদের রেহাই দিয়ে মর্যাদা দিয়েছেন।’

নতুন আইন যেন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগের হাতিয়ার না হয় এমন মন্তব্য করে মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘৫৭ ধারাটি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিকদের মর্যাদা দেওয়ার যে চেতনা তার ঠিক উল্টো। আমরা সাইবার ক্রাইম ও ডিজিটাল ক্রাইম দমনের জন্য আইন চাই। কিন্তু সেই আইনের মধ্যে এমন কোনও ধারা চাই না, যেটিতে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগের কোনও সুযোগ থাকে।’

অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কিত– সম্পাদক, সংবাদপত্রের মালিক, সিনিয়র সাংবাদিক, সংগঠনের নেতা, সাংবাদিকদের শিক্ষক, তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হলে একটা ভালো আইন হতে পারে। যেটি মিডিয়াবান্ধব হতে পারে বলে আমরা মনে করি।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘সাংবাদিকরা হচ্ছে এ আইনের প্রধান স্টেকহোল্ডার। ৫৭ ধারায় এপর্যন্ত যারা ভিকটিম হয়েছে তাদের মধ্যে সাংবাদিকরাই বেশি। কয়েকজন সাধারণ মানুষও ভিকটিম হয়েছেন। তবে সাংবাদিকরাই বেশি নির্যাতিত হয়েছেন। সাংবাদিকরা গণমাধ্যমের প্রধান কর্মী এবং আইনটির সঙ্গে গণমাধ্যমের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই ৫৭ ধারা বাদ দিয়ে নতুন যে আইন করা হবে, তার আগে অবশ্যই সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘যে আইন হচ্ছে, সেটির সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি, সবাই এটার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। আমরা হচ্ছি গণমাধ্যমের পেশাদার কর্মী। এ বিষয়ে একটি আইন হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেটা পেশাদার সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে কতটুকু বা অপেশাদারদের জন্য কতটুকু– তার উল্লেখ থাকতে হবে।  উন্মুক্ত যে যোগাযোগ মাধ্যম যেটাকে আমরা ব্লগ বলি, সেখানে তারা সম্পাদনা ছাড়াই মন্তব্য দিতে পারেন। কিন্তু গণমাধ্যমে যখন কোনও লেখা প্রকাশিত হয়, তখন সেটা সম্পাদিত হয়ে প্রকাশ হয়। আমরা মনে করি, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীরা এতে কতটুকু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবেন, যারা আইনটি তৈরি করছেন সেটি তাদের ভাবনায় নিতে হবে। সে কারণে এ পেশায় যারা বিশিষ্ট ব্যক্তি বা অংশীজন আছেন, তাদের মতামতের ভিত্তিতে করা হলে ভালো হবে। এখানে শুধু গণমাধ্যমকর্মী নয়, গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদেরও মতামত নেওয়া যেতে পারে।’

এ বিষয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার ব্যাপক অপপ্রয়োগ হয়েছে। বিশেষ করে সাংবাদিক সমাজের কাছে এই ধারাটি নিবর্তনমূলক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিপুলসংখ্যক সাংবাদিক এ ধারার কারণে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ ধারায় মামলা দেওয়া হয়েছে। অ্যারেস্ট করা হয়েছে। হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। তখন যদি আমাদের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া হতো বা আমাদের বিষয়গুলো যদি প্রাধান্য দেওয়া হতো তাহলে এ সংকট তৈরি হতো না। বিশেষ করে সাংবাদিকদের ওপর হয়রানি ও নিবর্তনের কারণে সাংবাদিকদের সঙ্গে রাষ্টের একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়, আমরা চাই এ শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকুক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে যেভাবে এ শক্তি এগিয়ে চলেছে, সেভাবে রাষ্ট্রটি যেন এগিয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি ৫৭ ধারার বদলে যে আইন করার চিন্তা-ভাবনা চলছে, সরকার সেটি করতেই পারে। কিন্তু সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে আইনটি কিভাবে প্রয়োগ হবে বা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে আইনটি কিভাবে দেখা হবে, সে বিষয়টি সাংবাদিকরা যতটা সুন্দরভাবে বলতে পারবেন বা সরকারকে সহযোগিতা করতে পারবেন, আমলারা সেটা পারবেন না। সেজন্য আমরা মনে করি সাংবাদিক, গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যে আইনগুলো তৈরি করা হবে সেগুলোর ক্ষেত্রে যদি সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ থাকে তাহলে সাংবাদিকদের সঙ্গে সরকারের কোনও দূরত্ব থাকবে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘৫৭ ধারায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাংবাদিকরা। এ ধারায় বহু সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এজন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠী যেহেতু তারা, সে কারণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, তাদের মন খুলে লেখালেখি করা– সেটা অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ নিয়ে সারাদেশে সাংবাদিক সমাজ মানববন্ধন করেছে, কথা বলেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আমরা দেখছি যে, ৫৭ ধারা বাতিল করছে ঠিকই, কিন্তু ৫৭ ধারার মতোই আরও কিছু ধারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে এক জায়গায় ছিল, এখন নানান জায়গায় দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাম দিয়ে নতুন আইন করা হচ্ছে। তাই সাংবাদিকদের সঙ্গে তো অবশ্যই, আরও অন্য যারা স্টেকহোল্ডার তাদের সঙ্গেও এ নিয়ে আলাপ করা উচিত বলে মনে করি। সাংবাদিকরা যেহেতু প্রধান ভিকটিম হয়েছেন, সেজন্য তাদের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলা উচিত।’  বাংলা ট্রিবিউন