ডিজিটাল আসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে বলে বিজ্ঞানীরা লক্ষ করছেন। পশ্চিমা দুনিয়ায় বলা হচ্ছে, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ‘স্ক্রিন অ্যাডিকশন’ দেখা দিয়েছে এবং তা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। অ্যাডিকশন মানে আসক্তি। কথাটা মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয়। এখন ইউরোপ–আমেরিকার লোকজন বলাবলি শুরু করেছেন, পর্দার প্রতি আসক্তি কোকেনের প্রতি আসক্তির মতোই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখে যাচ্ছে, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকছে। বাইরে বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা করা, মুখোমুখি বসে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি সব ধরনের ফেস–টু–ফেস ইন্টার–অ্যাকশনে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

এ রকম ক্ষতিকর প্রবণতার আশঙ্কা সবার আগে জেগেছিল প্রযুক্তি জগতের বড় বড় লোকদের মনে। কয়েক বছর আগেই তাঁরা এ বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। এখন আমরা অনেকেই জানি, বিশ্বখ্যাত ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবস তাঁর সন্তানদের নিজের প্রতিষ্ঠানের তৈরি আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেননি। তিনি একবার নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থেই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের যে কী ক্ষতি হচ্ছে, তা শুধু ঈশ্বরই জানেন।’

অ্যাপলের বর্তমান চিফ অপারেটিং অফিসার টিম কুক গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেছেন, তিনি জানেন যে একটা পর্যায়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের স্মার্টফোন দিতেই হবে, তবে তিনি চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব দেরি করে দেওয়া যায়।

মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ফোন ব্যবহার করতে দেননি।

ফেসবুকের প্রথম চেয়ারম্যান সিয়ান পারকার ফেসবুক ছেড়ে দেওয়ার পরে ফেসবুক সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘এই যে ক্ষণিক, ডোপামিন–তাড়িত ফিডব্যাক লুপস আমরা তৈরি করেছি, এটা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক সক্রিয়তা নষ্ট করে দিচ্ছে। সামাজিক আলাপ–আলোচনা নেই, পারস্পরিক সহযোগিতা নেই; আছে ভুল তথ্য আর মিথ্যা।’ তিনি এখন আর ফেসবুক ব্যবহার করেন না। এ ব্যাপারে তাঁর সাফ কথা, ‘আমার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে, তাই ওই “শিট” আর ব্যবহার করি না। কিন্তু ওদের (সন্তানদের) নিজেদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই আমি ওদের ওই “শিট” ব্যবহার করতে দিই না।’

ফেসবুকের সাবেক এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট আথেনা শাভারিয়া বলেছেন মজার কথা: ‘আমি নিশ্চিত, আমাদের ফোনের মধ্যে বাস করে শয়তান, সে ছেলেমেয়েদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে।’ তিনি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের হাইস্কুলে যাওয়ার আগে ফোন ব্যবহার করতে দেননি। এখনো বাড়িতে তাদের ফোন ব্যবহারের সময়সীমা কঠোরভাবে বেঁধে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, কোনো ক্লাসের সেই ছেলেটি বা মেয়েটিই সবচেয়ে ভালো করবে, যার হাতে ফোন পৌঁছাবে সবার পরে।

যেসব বিজ্ঞানী–প্রযুক্তিবিদ দীর্ঘ সময় ধরে নানা ধরনের ডিজিটাল যন্ত্র তৈরি করে আসছেন, তাঁরা সবচেয়ে ভালো জানেন, যন্ত্রগুলো কী প্রক্রিয়ায় ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্ক গ্রাস করে। এখন তাঁরাই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। যেমন আমেরিকার এক রোবটিকস ও ড্রোন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ক্রিস অ্যান্ডারসন বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, এই প্রযুক্তি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এটা সরাসরি চলে যাচ্ছে বিকাশমান মস্তিষ্কের প্লেজার সেন্টারগুলোতে। সাধারণ মা–বাবাদের পক্ষে ব্যাপারটা বুঝতে পারা একেবারেই অসম্ভব।’ তিনি এখন বলছেন, ক্যান্ডি আর ক্র্যাক কোকেনের মধ্যে ডিজিটাল স্ক্রিনের তুলনা করলে ডিজিটাল স্ক্রিনের বেশি মিল পাওয়া যাবে ক্র্যাক কোকেনের সঙ্গে।

ডিজিটাল প্রযুক্তিবিদ, কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ নিজেদের তৈরি করা ডিজিটাল যন্ত্র ও অ্যাপ থেকে সন্তানদের দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। আমেরিকার ‘সিলিকন ভ্যালি’র প্রযুক্তিবিদদের মধ্যে এ রকম একটা সাধারণ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে শিশু–কিশোরদের শেখার বা জ্ঞান অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল যন্ত্রের ভূমিকার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে এসব যন্ত্রের প্রতি তাদের আসক্তির ঝুঁকি। এই আসক্তির ক্ষতিকর ফলাফল ধরা পড়ছে মনোবিজ্ঞানী ও ব্যবহারবিজ্ঞানীদের গবেষণায়: শিশু–কিশোরদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, তাদের আচরণে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

আমেরিকার সিনসিনাটি চিলড্রেনস রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষকেরা সম্প্রতি ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই) প্রযুক্তির সাহায্যে শিশুদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁরা লক্ষ করেছেন, শিশুরা যখন কিছু পড়ে, তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ (ফাংশনাল ব্রেইন কানেকটিভিটি) বেড়ে যায়। আর যখন ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায় অডিও–ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট দেখে, তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ কমে যায়। তাই গবেষকদের পরামর্শ হলো, শিশুদের মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশের জন্য পড়ার সময় বাড়াতে হবে, পর্দায় চোখ রাখার সময় কমিয়ে আনতে হবে। আমেরিকান পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সে দেশের অভিভাবকদের পরামর্শ দিচ্ছে, ছেলেমেয়েদের ‘স্ক্রিন টাইম লিমিট’ বেঁধে দিতে হবে।

সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তিবিদদের ৯০০–র বেশি পরিবার ছেলেমেয়েদের পর্দা–আসক্তি কমানোর সংগ্রামে নেমেছে। শিশুদের সব ধরনের ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে—এমন পরিবারের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এই পরিবারগুলোকে বলা হচ্ছে ‘নো টেক হোমস’। এমনকি ওসব পরিবারে শিশুদের দেখাশোনার জন্য ন্যানিদেরও চুক্তি করতে হচ্ছে যে তাঁরা যতক্ষণ ওই বাসায় থাকবেন, ততক্ষণ ফোন ব্যবহার করবেন না।

যেসব পরিবারের কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা যন্ত্রের পর্দায় ভীষণভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের উদ্ধার করা সবচেয়ে কঠিন হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো মা–বাবা তাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, যন্ত্রগুলো তাদের মস্তিষ্কের ওপর কীভাবে কাজ করে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ওসব যন্ত্র তৈরিই করেছে মানুষের ব্রেইনকে ম্যানুপুলেট করে মুনাফা করার উদ্দেশ্যে।

বিশ্বের ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালির পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদের ওপর এমন জবরদস্তির খবরে মনে হতে পারে, একুশ শতকে এমন রক্ষণশীলতা বেমানান। কেউ কেউ বলছেন, আমরা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছি। এটা অজানা ভবিষ্যতের ব্যাপারে ভয়। বিজ্ঞান–প্রযুক্তির যাত্রা সব সময়ই সামনের দিকে; নতুন প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করলে মানবজাতি সর্বাধিক উপকার পেতে পারে, সেই পথ মানুষ নিজেই বের করে নেবে। এ নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু যন্ত্রের পর্দার প্রতি আসক্তি যদি মাদকাসক্তির মতোই মানুষের, বিশেষ করে শিশু–কিশোরদের বিকাশমান মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলে না। এখনই এর সমাধানের পথ খোঁজা দরকার। সেই পথ খুব কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক হলে ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম—এমন কথা মনোবিজ্ঞানীদের বলতে শোনা যাচ্ছে। ‘নো টেক হোম’ বা ‘নো স্ক্রিন টাইম বাজেট’ সঠিক সমাধান নয়। একটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। সিলিকন ভ্যালির পরিবারগুলোতে মধ্যপন্থী মা–বাবাও আছেন। তাঁরা ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল যন্ত্রের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে চান না; ব্যবহারের সময় কমানো এবং সঠিকভাবে ব্যবহারের ওপর জোর দিতে চাইছেন। যেমন কোনো কোনো মা–বাবা শিশুদের সীমিত সময়ের জন্য ব্রেইনস্টর্মিং গেম, পাজল ইত্যাদি খেলার অনুমতি দিচ্ছেন, কিন্তু ইউটিউবে ভিডিও দেখতে দিচ্ছেন না। কোনো কোনো পরিবার সপ্তাহে এক দিন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসে ভালো কোনো সিনেমা দেখছে। স্ক্রিন টাইম কমানোর বিষয়ে বিতর্ক চলছে। দৈনিক কতটা সময় ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত, কতটা হলে বেশি হয়, আর কতটা হলে একেবারেই কম হয়ে যায়, এ নিয়ে নানা রকমের মতামত আছে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশুদের হাত থেকে যন্ত্র কেড়ে নিলে সেই শূন্যতা অন্য কিছু দিয়ে পূরণ করতে হবে। মার্কিন ক্লিনিক্যাল চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকোলজিস্ট ড. রবার্ট মায়ার্স মনে করেন, গঠনমূলক ও আনন্দদায়ক বিকল্পের ব্যবস্থা না করে শিশু–কিশোরদের শুধু স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিলে তাদের নিরানন্দ ভাব চলে আসতে পারে, তারা বলতে পারে, কিছুই করতে ভালো লাগে না। তাই তাদের জন্য  ইন্টারেস্টিং বিষয়ে বইপত্র পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মা–বাবাকেও তাদের সঙ্গে পড়ায় অংশ নিতে হবে, যা পড়া হলো তা নিয়ে গল্প করতে হবে। প্রতিদিন ক্লাসের বইয়ের বাইরে নানা ধরনের বই পড়তে হবে, তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

পড়ার ওপরই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে এ জন্য যে মানুষ যখন পড়ে, তখন মস্তিষ্কের সক্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু শুধু পড়ায় আটকে রেখে শিশু–কিশোরদের জীবন আনন্দময় করা যাবে না, বুদ্ধির বিকাশ ঘটানো যাবে না। পড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার সুযোগ দিতে হবে, তাদের ফেস–টু–ফেস ইন্টার–অ্যাকশন বাড়ানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়াতে যাওয়ার আয়োজন বাড়ছে, যখন কোনো ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। ‘স্ক্রিন ফ্রি সামার ক্যাম্প’ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

এ পর্যন্ত যা বলা হলো, তার সবই ইউরোপ–আমেরিকার শিশু–কিশোর, তাদের মা–বাবা ও বিজ্ঞানী–গবেষকদের প্রসঙ্গে। আমাদের দেশেও ডিজিটাল যন্ত্রের প্রতি আসক্তি বা অতিরিক্ত ব্যবহারের প্রবণতা কিন্তু প্রায় একই রকমের। পার্থক্য এই যে ইউরোপ–আমেরিকার অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের নিয়ে চিন্তা করছেন, ডিজিটাল আসক্তি থেকে তাদের উদ্ধার করার উপায় খুঁজছেন, আর আমাদের এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা একদিকে পরীক্ষায় ভালো ফল করার প্রতিযোগিতায় শৈশব–কৈশোরের আনন্দ থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে ডিজিটাল যন্ত্রে ভিডিও গেম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত।

তাদের উদ্ধার করার কথা কেউ কি ভাবছেন?

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
mashiul.alam@gmail.com