ট্রাকচাপায় নিহত হিমেল, নিরাপত্তা ছাড়াই চলছিল ভবনের নির্মাণ কাজ

রেদওয়ানুল হক:

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঝুঁকি নিয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ করা হচ্ছিল বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্যাম্পাসে নির্মাণ সামগ্রী বহনকারী ট্রাক চলাচলে গতি, মিস্ত্রি ও শ্রমিকদের সুরক্ষার কোনো কিছুতেই সতর্কতা মানা করা হয়নি। ফলে প্রায় মাসখানেকের ব্যবধানেই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল ও নির্মাণ শ্রমিক মো. আলেক (৩৫) আলীর মৃত্যু হয়।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, সঠিক নিয়ম-নীতি ও সাবধানতা অনুসরণ করা গেলে হয়ত দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর বলছে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ঠিকই সব ধরনের নিরাপত্তা ও সাবধানতা অবলম্বন করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০১৫ সালে ৩৬৪ কোটি টাকার একটি বাজেট পাস হয়। সেই বাজেটে শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ তলাবিশিষ্ট দুটি আবাসিক হল, একটি ২০ তলা একাডেমিক ভবন ও শিক্ষকদের জন্য একটি ১০ তলা টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। গতবছরের শেষের দিকে এসব ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ তলা হল ও ২০ তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণের কাজ করছে রূপপুরের বালিশকাণ্ডে জড়িত সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ অ্যান্ড সন্স কনস্ট্রাকশন। এছাড়াও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের সংস্কার কাজ করছে হুসেন কনস্ট্রাকশন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে মিলনায়তনের ছাদ ও দেয়াল মেরামত, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা সংযোজন, দর্শকদের বসার চেয়ার, স্টেইজসহ মিলনায়তনের প্রায় সবকিছুই সংস্কার করা হচ্ছে। মিলনায়তনের ছাদটি দু’দিকে বেশ ঢালু। সেখানে নেই কোনো রেলিং। ঢালু ছাদের উপরেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ চলত। এছাড়াও পাটের মোটা দড়ি দিয়ে বাঁশ বেধে সেগুলোতে ঝুলে ঝুলে মিলনায়তনের দেয়ালে কাজ করত মিস্ত্রি-শ্রমিকরা।

এদিকে, নির্মাণাধীন ১০ তলা আবাসিক হলের এক শরিফুূল ইসলাম নামের এক নিরাপত্তা প্রহরীর সঙ্গে নির্মাণ স্থান ঘুরে ঘুরে মিস্ত্রিদের কাজ করার বিষয়ে কথা হয়। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুতল ভবনগুলো নির্মাণের জন্য যেই তিনটি সাইটে কাজ চলছে তাতে রডমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, পাইলিং মিস্ত্রি, বেকোগাড়ি চালকসহ পাঁচশ’রও বেশি মিস্ত্রি-শ্রমিক কাজ করত। কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকত না। দিন-রাতই কাজ চলত। তার বর্ণনা অনুযায়ী, মিস্ত্রি-শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকি নিয়েই কাজ করত তারা।

গত ৮ই জানুয়ারি মিলনায়তনের সংস্কার কাজ করার সময় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হন মো. আলেক। পরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মো. আলেক রাজশাহীর বেলপুকুর থানার কাপাসিয়া এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে। এদিকে, গত মঙ্গলবার (০১ ফেব্রুয়ারি) ক্যাম্পাসে নির্মাণ সামগ্রী বহনকারী ট্রাকের চাপায় মারা যান চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল। সে গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়ত। এ ঘটনায় পায়ে আঘাত পায় তার বন্ধু রায়হান প্রামানিক। তার অবস্থা এখন অনেকটাই ভাল। ঘটনার পর থেকেই ক্যাম্পাসে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়।

রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, নির্মাণ কাজ শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ শুরুর অনুরোধ জানিয়েছিলাম। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানেরও সকলের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সতর্কতা অবলম্বন করে কাজ করলে হয়ত পরিস্থিতি এমন না-ও হতে পারত।

এ বিষয়ে মজিদ অ্যান্ড সন্স কনস্ট্রাকশনের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মিলনায়তন সংস্কার কাজের তত্ত্বাবধানকারী মমতাজ উদ্দিন ডন বলেন, আমরা তো সবাইকেই কাজের সময় সতর্ক থাকতে বলতাম। এখন দুর্ঘটনা তো আর বলে আসে না। তবে এখন কাজ আপাতত বন্ধ আছে। কাজ চালু হলে নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।
মিলনায়তন সংস্কার কাজ দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মিনহাজুল আলম জানান, কাজ করার সময় সেফটি ব্যবহার করার কথা আগে থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল।

প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী শাহরিয়ার রহমান বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আমরা মৌখিক এবং লিখিত উভয়ভাবেই পরামর্শ দিয়েছিলাম। এরপরেও তারা এক প্রকার সেটা আমলে নেয়নি।

স/আর