জয় লেখকের স্বেচ্ছাচারিতা, পদে পদে উপেক্ষিত ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য কমিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩ ডিসেম্বর। আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এই সংগঠনের ৩০তম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিদায় নিচ্ছেন আলোচিত-সমালোচিত এই দুই নেতা।

প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন মানবিক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা কুড়ালেও পদে পদে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে নিয়েছেন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত। কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সংগঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটিকে যুক্ত করার পরিবর্তে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন দু’জন মিলে।

সংগঠন পরিচালনায় তাদের চরম স্বেচ্ছাচারিতায় বিতর্কিত হয়েছে গোটা নেতৃত্ব। সর্বশেষ শোকের মাস আগস্টের এক দিন আগে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধু চিঠি দিয়ে বানিয়েছেন বর্ধিত কমিটির পাঁচ শতাধিক নেতা। কেন্দ্রীয় অন্য নেতারা এসব অনিয়ম নিয়ে দফায় দফায় প্রতিবাদ জানালেও তা আমলেই নেননি জয় ও লেখক।

ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ মেয়াদ শেষ করার আগেই ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারা পদত্যাগ করেন।

এরপর সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান যথাক্রমে আল নাহিয়ান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। তিন মাস ভারপ্রাপ্ত থাকার পর ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের ভারমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভারমুক্ত হওয়ার পর প্রায় তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছেন জয়-লেখক। এর মধ্যে তারা করোনাকালে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এবং হাওড়ের কৃষকদের ধান কেটে সুনাম কুড়িয়েছে সাধারণ মানুষসহ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনারও।

তবে সম্মেলনের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠনের গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও গঠনতন্ত্রকে উপেক্ষা করে একের পর এক প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি দিয়েছেন। দুই মাস অন্তর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করার নিয়ম থাকলেও তিন বছরেও করেননি একটিও।

গঠনতন্ত্রে আছে, কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কিন্তু সেই দায়িত্বের অপব্যবহার করেছে তারা। এ ছাড়া ছাত্রলীগের ১১৯টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে কমিটি হয়েছে মাত্র ৩৮টি। বাকিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ।

৮১টি ইউনিট কমিটিই বাকি : গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের জেলা ইউনিট ১১১টি। যদিও তাদের সময়ের মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বাড়লে ১১৯টি ইউনিট কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৮টি কমিটি দিতে পেরেছে তারা।

বাকি রয়েছে ৮১টি কমিটি। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির একটি অংশের অভিযোগ, এসব কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির বড় একটি অংশের। রাজশাহীর সদ্য বহিস্কৃত জেলা সভাপতি সাকিবুল হাসান রানাকেও লেখক ভট্টাচার্যের বাড়ির বাজার পর্যন্ত করে দিতে হতো বলে অভিযোগ রয়েছে।

আবার ৩৮টি কমিটির মধ্যে ঢাকায় অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইডেন মহিলা কলেজের কমিটি গঠনের পর শীর্ষ নেতৃত্বের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে তা স্থগিত করা হয়।

যদিও শনিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়াও, ঢাকায় অবস্থিত শীর্ষ কয়েকটি কমিটির মধ্যে ঢাকা কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বাংলা কলেজ এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজের কমিটি দিতে পারেনি।

নামেমাত্র দায়িত্ব বণ্টন : ছাত্রলীগের প্রতিটি ইউনিটে তদারকির জন্য দুই থেকে তিনজন কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব ইউনিটের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পরামর্শ গ্রহণের রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। কিন্তু কমিটি গঠনে দায়িত্বরতদের কোনো পরামর্শ নেননি জয়-লেখক।

এসব কমিটিতে অপরাধীদের পদায়নের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের পক্ষ থেকে অভিযোগ থাকলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি জয়-লেখক।

বর্ধিত কমিটিতে জায়গা দিয়ে পাঁচ শতাধিককে সন্তুষ্টি : গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ ২৫১টি। তবে, সেটি বাড়িয়ে করা হয় ৩০১টি। শোভন-রাব্বানীর সময়ে দেওয়া এসব পদের প্রায় শতাধিক নেতা চাকরি, ব্যবসায় কিংবা বিবাহ করায় সেই পদগুলো খালি হয়।

সেটি পূরণ হয় গত আগস্ট মাসে। কিন্তু সংগঠনটির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, একশত পদের বিপরীতে প্রায় পাঁচ শতাধিককে পদায়ন করা হয়। অভিযোগ আছে, কমিটি বড় করার নেপথ্যে ছিলেন-আল নাহিয়ান খান জয়ের ঘনিষ্ঠ এসএম রিয়াদ হাসান এবং লেখক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ তুহিন রেজাসহ বেশ কয়েকজন নেতা।

যদিও তারা এ অভিযোগ সবসময়ই অস্বীকার করেছেন। এই সংখ্যার বাইরেও আগস্ট মাসের শেষে আরও অর্ধশতাধিককে পদায়ন করা হয়। এসব পদায়নকৃত নেতাদের যাচাই-বাছাই না করেই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তাদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে, শিবির-ছাত্রদল সম্পৃক্ততা, ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি, ছাত্র নির্যাতন, মাদকসেবনসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ।

এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগের নতুন সম্মেলনের সময় নির্ধারণ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। তবে, এগুলো সংশোধন করতে হবে। নতুন নেতৃত্ব গঠনের মধ্যেমে সংগঠন আরও সুন্দর হবে।

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেন, করোনার কারণে তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এখন আগামী সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের হাত ধরে ছাত্রলীগ তার পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে যাবে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সোহান খান যুগান্তরকে বলেন, যে চ্যালেঞ্জ জয় লেখকের সামনে ছিল সেটি তারা মোকাবিলা করতে পারেনি। ভারপ্রাপ্ত অবস্থায় তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও ভারমুক্ত হওয়ার পর সাধারণ সভা না করা, প্রেস রিলিজে কমিটি করা এবং নামমাত্র দায়িত্ব বণ্টনের মাধ্যমে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করেছেন। যার ফলে ছাত্রলীগের যে ইতিহাস ঐতিহ্য সেটি জয়-লেখক ধারণ করতে পারেনি।

উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে গত দুদিন একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তারা সাড়া দেননি। পরে একই নম্বরে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তারা কোনো বক্তব্য দেননি। সূত্র: যুগান্তর