জয়িতা, রাজশাহীর নাজমা: শু ফ্যাক্টরিতে দিনবদল

সিল্কসিটিনিজ ডেস্ক: রাজশাহীর মেয়ে নাজমা খাতুন। প্যারামেডিক্যাল কোর্স শেষে ২০০০ সালে ঢাকায় একটি প্রাইভেট কম্পানির চাকরিতে যোগ দেন।

চাকরিরত অবস্থায়ই ২০০৫ সালে একটি সমিতি থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছোট্ট পরিসরে স্থাপন করেন জুতা তৈরির কারখানা। অফিস শেষে নিজের কারখানায় কাজ করতেন। তাঁর সেই শ্রম বৃথা যায়নি। নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে নাজমা আজ কোটিপতি। ফরহাদ হোসেনকে শোনালেন তাঁর শূন্য হাতে কোটিপতি হয়ে ওঠার গল্পটা

পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল মা আর মামাদের সঙ্গে। সেই ঝামেলার অনেকটা জের এসে পড়ত আমার ওপরও। নানা দ্বন্দ্ব ও ঝামেলার কারণে মনটা একেবারে ভেঙে যায়। একে পারিবারিক কলহ, আবার অল্প বয়সে কঠিন বাস্তবতা আমাকে অনেকটা জেদি করে তোলে। এসব কারণে বাড়ি থেকে চলে যাই এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

তখন আমি মাত্র এইচএসসিতে পড়ি। বাবা আমাকে বলতেন—মা, বাড়ি চল। অনেক বিষয়ে বোঝাতেন। আমি বলতাম, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব। নিজের মাঝে সব সময় একটা চিন্তা কাজ করত, কিভাবে নিজেকে স্বাবলম্বী করব, যাতে আমার দুঃখবোধটা মুছতে পারি।

শুরুর কথা

ঢাকার একটি প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করতাম। অল্প বেতনের চাকরি। স্বামীসহ দুজনে মিলে বেতন যা পেতাম, তা দিয়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া ও মেয়ের খরচ জুগিয়ে কোনোমতে সংসার চলত। ভাবতাম, এভাবে আর কত দিন। ভাগ্যবদলে অন্য কিছু ভাবতে হবে। আমার স্বামী কাজ করত ঢাকার একটি জুতার ফ্যাক্টরিতে। ভাবতাম, ছোট পরিসরে একটা জুতার ফ্যাক্টরি দিলে কেমন হয়। তার জুতার ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সুবাদে প্রায়ই এ নিয়ে কথা হতো। অবশেষে সাহস করে কাজে হাত দিলাম। একটি সমিতি থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে ২০০৫ সালে নিজ উদ্যোগে একটি রুম ভাড়া নিয়ে ছোট্ট পরিসরে শুরু করলাম ‘কুসুম কলি শু ফ্যাক্টরি’ নামে একটি জুতা তৈরির কারখানা। মাত্র দুজন শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করি। এর মধ্যে ২০০৬ সালে বিসিকের স্কিটি থেকে উদ্যোক্তা উন্নয়ন বিষয়ে একটি কোর্স করি। পরবর্তী সময়ে কর্মীসংখ্যা ও কাজের পরিধি বাড়তে থাকলে ২০১২ সালে এইচআরএম, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড বুককিপিং এবং এক্সপোর্ট মার্কেটিং বিষয়ে কোর্স করি। এ কোর্সগুলো আমার কাজের বিষয়ে বেশ সহায়ক হয়েছে।

উঠে আসার কথকতা

২০০৭ সালে আমি প্যারামেডিক্যালের চাকরি ছেড়ে কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে নিজের পুরো সময় দিতে থাকি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজ হাতে নানা ধরনের কাজ করি। কাজের টুকটাক অর্ডার আসতে থাকে। এর মধ্যে বে-অ্যাম্পেরিয়াম থেকে বেশ বড় একটি কাজের অর্ডার পেলাম। কর্মীসংখ্যা বাড়িয়ে অর্ডারটা ঠিক সময়ের মধ্যেই শেষ করলাম। তারা আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে অর্ডার বাড়াতে থাকল। ২০১০ সালে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ পাই। তা দিয়ে আমার কর্মীসংখ্যা ও স্পেস বাড়াই। আমার কাজের সাফল্য দেখে ইসলামী ব্যাংক এক বছরের মধ্যে ঋণের পরিধি ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়াল। ঋণ পেয়ে ক্রমেই বাড়তে থাকল আমার কাজের পরিধিও।

 

ছোট্ট ঘর থেকে নিজের ফ্ল্যাটে

প্রচুর অর্ডার আসার ফলে লাভের অংশ দিয়ে নিজে থাকার জন্য বাড্ডায় একটি ফ্ল্যাট কিনি। নিজ ফ্ল্যাটে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে আমার ছোট্ট সংসার! কিছুদিন হলো বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, আর ছোট দুই মেয়ের মধ্যে একজন পঞ্চম শ্রেণিতে, আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে পড়ছে ক্লাস ওয়ানে। সংসার আর ব্যবসা—এই নিয়ে আমার জীবন।

 

পুড়ল কারখানা

ফ্ল্যাট কেনার আগেই আমার কারখানা বাড্ডা থেকে গাজীপুরে শিফট করি। তখন কারখানায় ৬৫ জন কর্মী কাজ করত। এরই মধ্যে জেনিস থেকে একটা বড় অর্ডার পেলাম। জেনিসের কাজ চলছে পুরোদমে। ২০১২ সালের ২৫ জুন রাতে হঠাৎ আগুন লেগে কারখানার সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মনে হলো, সেই সঙ্গে আমার সব অর্জনও পুড়ে ছাই হয়ে গেল। অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যায়। সঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়ে কারখানায় কর্মরত সব শ্রমিক। তখন আমি কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের বেতন এবং আবার চাকরির আশ্বাস দিয়ে আসতাম। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি ঘুরে দাঁড়াতে পারব। তখন বাটাসহ অন্য বেশ কিছু নামকরা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এক বছরের মধ্যে আমার চাচাশ্বশুরের একটি জায়গায় আবার কারখানা আগের মতো করে গড়ে তুলি। এর পরপরই বাটা থেকে প্রচুর কাজের অর্ডার পেলাম। সঙ্গে অন্যদের অর্ডার তো আছেই। এভাবেই দিন-রাত চলতে থাকল কাজ।

 

বিদেশেও নাজমার শু

২০১৩ সালের নভেম্বরে আমি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে গিয়ে সেখানকার বিজনেস প্ল্যান, সম্ভাবনা, সুবিধা ইত্যাদি যাচাই করে আসি। পরে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ট্রেডিং বিজনেস শুরু করি। নিজের কারখানার তৈরি প্রডাক্ট হোলসেল বিক্রির জন্য নেওয়া হয়েছে শোরুম ও স্টোর স্পেস। সেখানে নেওয়া শোরুম চালান এ দেশের তিনজন র্কমচারী।

 

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে গাজীপুরে আমার কারখানায় কাজ করে ২০০-র বেশি শ্রমিক। যাদের বেশির ভাগই নারী। এক্সপোর্ট প্রডাক্ট তৈরির জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে ১০ হাজার বর্গফুটের ফ্লোর স্পেস। ইসলামী ব্যাংক ব্যবসা আরো সম্প্রসারণের জন্য ঋণ পরিধি বাড়িয়েছে আড়াই কোটি টাকা। বর্তমানে কাজ করছি বাটা, বে, জিলসসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কর্মীদের বেতন বাবদ প্রতি মাসে খরচ হয় ১০ লাখ টাকার মতো। রয়েছে নিজের কারখানা ভবন। কেনা হয়েছে আরো একটি কারখানার জমি। এরই মধ্যে স্বীকৃতিও মিলেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ করার জন্য এ বছর পেয়েছি ইউসুফ চৌধুরী সম্মাননা ২০১৭।

 

ভবিষ্যতের কথা

আমি রাজশাহী থেকে বলা যায় শূন্য হাতেই এসেছিলাম ঢাকায়। ছোটবেলায় জীবনটা ছিল অনেক কষ্টের। জীবনের নানা বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। অল্প বেতনে চাকরি করে অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। পরে তিলে তিলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কারখানা গড়ে তুলেছি। নিজ হাতে নিজের কারখানায় কাজ করেছি। আজও শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। চলতে থাকবে এ শ্রম দেওয়া। ব্যবসায়িক পরিধিটা আরো বাড়াতে চাই। যাতে আরো অনেককে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারি। কর্মীদের সব সুযোগ-সুবিধা দিতে চাই। আমি একজন প্যারামেডিক হওয়ায় আমি জানি কর্মীদের কী ধরনের স্বাস্থ্যগত সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে মেয়েদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে সব সময় আমার নজর থাকে। তাদের কাজের সঠিক পরিবেশ যেন থাকে, সে খেয়ালও রাখি।

 

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য

অনেক মেয়েই এখন স্বাধীনভাবে কিছু করতে চায়। তাদের বলব, আগে লক্ষ্য স্থির করুন। অনেক পরিশ্রম করতে হবে। সততা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের পরিবেশে মেয়েদের কাজে অনেক বাধা। সেগুলোকে ভয় পেলে চলবে না। সাহস রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ফিন্যান্স একটা বড় সমস্যা। সঠিক পরিকল্পনা আর উদ্যমী হলে কোনো বাধাই বাধা হয়ে থাকে না।

 

 

সূত্র: কালের কণ্ঠ