জয়পুরহাটে চারটি শুকনো নদীর বুকে এখন ফসলের চাষ

নিজস্ব প্রতিবেদক, জয়পুরহাট:
বাস্তবে না দেখলে বুঝার কোনো উপায় নেই আসলে এগুলো নদী না ফসলের মাঠ। ইরি-বোরো মৌসুম এলেই এই নদীগুলো দখল হয়ে যায়। জয়পুরহাটের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট যমুনা, তুলশী গঙ্গা, শ্রী নদী ও হারাবতী নদীর গর্ভে এখন শুধুই ফসল আর ফসল। চেনার কোনো উপায় নেই। বলতে গেলে এলাকার জনসাধারণ এক প্রকার প্রতিযোগিতা করেই এ চারটি নদী দখল করে ফসল ফলায়। নদীগুলো দিয়ে একসময় পাল তুলে চলছিল নৌকা। কোথাও বা জাল দিয়ে জেলেরা ধরছিল মাছ। তীরে আবার কলসি কাঁধে নিয়ে গ্রামের বধূরা নিতে যাচ্ছিল পানি। নদীর বুক বয়ে এপার থেকে ওপারে যেতে সংযোগকারী সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে যেত জলধারা। এই তো নদীর খেলা। কিন্তু বাস্তবে তা না হয়ে বর্তমানে জলহীন নদীর বুক দখল করে চাষ হচ্ছে ফসল। নদীগুলো দেখে বুঝার কোন উপায় নেই এগুলো আসলে নদী না ফসলের মাঠ। ছোট যমুনা, তুলশী গঙ্গা, শ্রী নদী ও হারাবতী নদী এখন শুধুই জয়পুরহাটের নাম সর্বস্ব নদী।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে পলি জমে এ চারটি নদীর বুক ভরাট হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেই থেকে নদীগুলো আর সংস্কারও করা হয়নি। অনেক আগে থেকেই নদীর তলদেশ দখল করে ফসল ফলাত তীরবর্তী বাসিন্দারা। এখন নদীগুলো আর তাদের দখলে নেই। বর্তমানে এলাকার প্রভাবশালীরা এ চারটি নদীর গর্ভ দখলে নিয়েছে। যে যার মত গড়ে তুলেছেন ফসলের মাঠ। নদীর গর্ভে চাষ হচ্ছে ধান, মিষ্টি আলুসহ নানা ফসল। আবার বর্ষা মৌসুম এলেই এ মরা নদীগুলো দুঃখের ঢল হয়ে দাড়ায়। উজান থেকে নেমে আসা বর্ষার পানি নামতে পারে না ভাটিতে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই এলাকা প্লাবিত হয়। সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতা। অস্বাভাবিক বন্যায় ক্ষতি হয় ফসলের। তখন পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করে হাজার হাজার মানুষ।

জেলার ত্রাণ ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অনেক কর্মকর্তারা বলেন, বর্ষাকালে বন্যায় ফসল, কাঁচা-পাকা বাড়িঘর, রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে এ জেলায় প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়। সে হিসেবে গত ১২ বছরে ক্ষতির পরিমাণ হয়েছে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

সদর উপজেলার চকশ্যাম গ্রামের কৃষক মহির উদ্দিন, ক্ষেতলাল উপজেলার সোনামূখী গ্রামের আব্দুল বারীক, পাঁচবিবি উপজেলার বড়মানিক গ্রামের আবুল খায়ের জানান, খরা মৌসুমে নদীগুলি শুকিয়ে যায়। প্রতিযোগীতা করে নদীর বুকে ধান চাষ করছে প্রভাবশালীরা। বর্ষা মৌসুম এলেই বৃষ্টিতে মাঠের পর মাঠ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে ফসলের হানি ঘটে। অথচ জেলার এই নদীগুলো দিয়ে এক সময় নৌকা চলত আবার মাছ চাষও হতো। খরা মৌসুমে নদীর পানি দিয়ে এলাকার জমিতে ফসল চাষ হতো। সংস্কারের অভাবেই এ নদীগুলো আজ মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। সরকারি অফিসগুলো থেকে লোকজন মাঝে মধ্যে নদীতে এসে খননের জন্য মাপ যোগ করে যায় কিন্তু পরে আর নদী খনন হয় না।

পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জি ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা ও ক্ষেতলাল উপজেলার তুলশিগঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান হাইকুল ইসলাম জানান, ভারতের সীমানার অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয়ে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে জয়পুরহাট জেলায় প্রবেশ করেছে এ জেলার চারটি নদী। কিছু দিন আগেই পানিতে ভরা থাকত এ নদীগুলো। নৌকা চলত ও মাছ চাষও হতো। সড়ক পথের চেয়ে নদীপথ ব্যবহৃত হতো বেশি। পার্শ্ববর্তী জেলার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমই ছিল এ নদীগুলো। কিন্তু আজ তা হয়না। বরং বর্ষার সময় উজান থেকে যে পানি আসে তা মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাড়ায়। আবার শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকে চর জেগে উঠে। নদীর গর্ভে বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ হচ্ছে।  ১৯৮২ সালে তুলসীগঙ্গা নদী খনন কাজ শুরু হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। আরও তিনটি নদী কোনও দিন খনন করা হয়নি।

নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক পানি উন্নয়ন বিভাগে এক কর্মরত পানি বিশেষজ্ঞ জানান, নদীগুলো খনন করে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করা না গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা আছে। জয়পুরহাটের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তুলসীগঙ্গা, ছোট যমুনা, হারাবতী এবং চিরি নদী পুন:খনন না করায় নাব্যতা সংকটে পড়েছে।

জয়পুরহাট পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, রফিকুল আলম চৌধুরী জানান, চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় জয়পুরহাটের চারটি নদী পুন:খননের জন্য ১৪৬ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়েছে। অর্থ পেলেই কাজ শুরু হবে এবং নদীগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

স/শা