জ্বালিয়ে দেওয়া সেই ছাত্রাবাসে এবার সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষত

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে এক তরুণী (২০) সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গত শুক্রবার রাতে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের সামনে এ ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত ধর্ষণকারী সবাই ছাত্রলীগের কর্মী বলে জানা গেছে। ওই তরুণী তাঁর স্বামীকে নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এ ঘটনার পর ভোররাতে ছাত্রাবাস ও আশপাশ এলাকায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করলেও ধর্ষকদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

এ ঘটনায় সিলেটজুড়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এমসি কলেজের প্রধান ফটকসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে গতকাল শনিবার সারা দিন বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।

২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরে কলেজের ছাত্রাবাসটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সে সময় দেশ-বিদেশে ঘটনাটি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এরপর শুক্রবার তরুণী ধর্ষণের ঘটনাটি এমসি কলেজের ইতিহাসে আরেকটি ক্ষতের জন্ম দিল।

জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার তরুণীর বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমায়। তিনি শুক্রবার বিকেলে স্বামীসহ নিজেদের গাড়িতে করে শহরের টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজে বেড়াতে যান। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি রেখে তাঁরা একটি দোকানে কেনাকাটা করেন। পরে গাড়িতে ফিরে তাঁরা গল্প করছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকজন যুবক তাঁদের গাড়ির কাছে আসে। তারা তরুণীকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে স্বামী বাধা দেন। তখন তাঁকে মারধর করে দুর্বৃত্তরা। একপর্যায়ে তারা জোরপূর্বক গাড়িতে উঠে স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে পাশের বালুচর এলাকায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে নিয়ে আসে। সেখানে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের সামনে গিয়ে স্বামীকে গাড়ি থেকে বের করে আটকে রাখে এবং স্ত্রীকে গাড়িতে ধর্ষণ করে। প্রায় এক ঘণ্টা পর স্বামীকে ছেড়ে দিলে তিনি ৭ নম্বর ব্লকের সামনে স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পান। এ সময় তিনি টিলাগড়ের এক নেতাকে মোবাইল ফোনে ঘটনার কথা জানান। যিনি একসময় জেলা ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ছিলেন। ওই নেতা টিলাগড়ের আরেকটি বলয়ের প্রভাবশালী নেতা। তিনি আসার পর ধর্ষণকারীরা চলে যায়। এ সময় ধর্ষণকারীদের বলয়ের নেতারা ঘটনা চাপা দিতে আপসরফার চেষ্টা চালান। দীর্ঘসময় চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি ভয়ভীতিও প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু ধর্ষিতার স্বামী এবং ওই নেতা বিষয়টি মানেননি। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানা-পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে আসে। পুলিশ ধর্ষণের শিকার তরুণীকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) পাঠায়। এ সময় ধর্ষকদের ফেলে যাওয়া একটি মোটরসাইকেল জব্দ এবং ওই দম্পতির ব্যবহৃত প্রাইভেট কার উদ্ধার করে।

নাম প্রকাশ করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, ধর্ষণকারীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রনজিত সরকার গ্রুপের অনুসারী।

মামলায় যাঁরা আসামি : এমসি কলেজ ছাত্রাবাস এলাকায় গণধর্ষণের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার তরুণীর স্বামী বাদী হয়ে গতকাল শনিবার সকালে শাহপরান থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ছয়জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাহপরান থানার ওসি কাইয়ূম চৌধুরী।

মামলায় উল্লেখ করা ছয় আসামি হলেন এম সাইফুর রহমান (২৮), তারেকুল ইসলাম (২৮), শাহ মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), অর্জুন লস্কর (২৫), রবিউল ইসলাম (২৫) ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুম (২৫)। তাঁদের মধ্যে রবিউল ও তারেক ছাড়া অন্যরা এমসি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী।

মামলার এজাহার অনুসারে, সাইফুর রহমানের বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে এবং বর্তমান ঠিকানা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কের বাংলো। শাহ মাহবুবুর রহমানের বাড়ি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বাগুনিপাড়া ও বর্তমান ঠিকানা ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের ২০৫ নম্বর কক্ষ। মাহফুজুর রহমানের বাড়ি কানাইঘাটের গাছবাড়ী গ্রামে, রবিউলের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামে, অর্জুনের বাড়ি জকিগঞ্জের আটগ্রাম ও তারেকের বাড়ি সুনামগঞ্জ শহরের নিসর্গ আবাসিক এলাকায় (হাসননগর)।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, সাইফুর, রনি ও মাহফুজুর ইংরেজি বিভাগের স্নাতক শ্রেণির অনিয়মিত শিক্ষার্থী। অর্জুন সাবেক শিক্ষার্থী। রবিউল বহিরাগত। ছয় ধর্ষকের কেউ সাবেক শিক্ষার্থী আবার কেউ বহিরাগত হলেও এমসি কলেজের ছাত্রাবাসই ছিল তাঁদের ঠাঁই।

ছাত্রাবাসে অভিযান : ঘটনার পর শুক্রবার রাতেই ছাত্রাবাসে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে ছাত্রাবাসের কক্ষ থেকে একটি পাইপগান, চারটি রামদা, দুটি চাপাতি ও একটি ছোরা উদ্ধার করা হয়েছে। মামলার অসামি সাইফুর রহমান এই কক্ষে থাকতেন বলে জানা গেছে।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোতির্ময় সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধর্ষণকারীদের শনাক্ত করতে শুক্রবার রাত থেকে পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে। ভোররাতে শাহপরান থানার এক দল পুলিশ ছাত্রাবাসে তল্লাশি করে একটি কক্ষ থেকে পাইপগানসহ অস্ত্র উদ্ধার করেছে।

অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গতকাল সকাল ১১টার দিকে শাহপরান থানায় একটি মামলা করেছে। এ মামলার একমাত্র আসামি করা হয়েছে ছাত্রলীগকর্মী সাইফুর রহমানকে।

শাহপরান থানার ওসি কাইয়ূম চৌধুরী বলেন, ‘যে কক্ষ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, ওই কক্ষে সাইফুর থাকতেন।’

তদন্ত কমিটি : তরুণীকে ধর্ষণ ঘটনার তদন্তে কলেজ কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে কলেজের ?গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জীবন কৃষ্ণ আচার্য ও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জামাল উদ্দিন। তাঁরা দুজনই ছাত্রাবাসের সুপারের দায়িত্বেও আছেন।

কলেজের অধ্যক্ষ মো. সালেহ আহমদ বিষয়টি নিশ্চিত করে  বলেন, সার্বিক বিষয় তদন্তের জন্য কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ : ঘটনার প্রতিবাদে এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এমসি কলেজ ও সরকারি কলেজের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে টিলাগড়-শাহপরান রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ থাকার পরও ছাত্রাবাস কিভাবে খোলা রাখে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ অবগত থাকার পরও ছাত্রাবাস বন্ধ করেনি।

এ ছাড়া বাসদসহ বিভিন্ন সংগঠন নগরে প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে।

নিন্দা ও বিচার দাবি : এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ, নিন্দা জানিয়ে ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন সিলেটের বিশিষ্ট নাগরিকরা। এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, এ ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ঐতিহ্যবাহী ক্যাম্পাসের মতো নিরাপদ স্থানে এই ধরনের ঘটনা পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। এর দায় শাসকদল কোনোভাবে এড়াতে পারে না।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি ব্যারিস্টার মো. আরশ আলী, সিলেট জেলা জাসদ সভাপতি লোকমান আহমদ, সিপিবির সাবেক সভাপতি বেদানন্দ ভট্টাচার্য, প্রবীণ আইনজীবী মুজিবুর রহমান চৌধুরী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম প্রমুখ।

দুই দারোয়ান বরখাস্ত : ধর্ষণের ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে দুই দারোয়ানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ।

সাময়িক বরখাস্তকৃতরা হলেন কলেজের প্রধান ফটকের দারোয়ান রাসেল মিয়া ও চৌকিদার সবুজ আহমদ রুহান।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ